সাইবার নির্যাতনের শিকার ৫৯ ভাগ নারী

সাইবার নির্যাতনের শিকার ৫৯ ভাগ নারী

ছবিঃ সংগৃহিত

ফেসবুকের সুবাদে আরিশ নামের এক ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থী অনামিকার (ছদ্মনাম)। এক পর্যায়ে দুজনের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। কয়েক মাস পর সম্পর্কের অবনতি হয়। আরিশ তখন ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে অনামিকাকে ব্যক্তিগত ছবি ফাঁস করার হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে এবং টাকা দাবি করে। কিছু টাকা দেয়াও হয়। কিন্তু পরে আরিশ বড় অঙ্কের অর্থ দাবি করলে অনামিকার পরিবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানালে দুই বন্ধুসহ আরিশকে আটক করে পুলিশ।

তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। গত এক বছরে দেশে দ্বিগুণ হারে বাড়ছে সাইবার অপরাধের নতুন মাত্রা। যা এই সময়ে মোট অপরাধের ১১ দশমিক আট পাঁচ শতাংশ। সাইবার অপরাধে আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা ৫৯ ভাগই নারীরা। তবে লোক লজ্জার ভয়ে আইনের আশ্রয় নিতে চান না ভুক্তভোগীরা। চলতি বছরের ২৯ জুন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিক্যাফ) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে সাইবার অপরাধপ্রবণতা ২০২৪’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্রই। গবেষণার তথ্যমতে, অপরাধের শীর্ষে রয়েছে সোশাল মিডিয়া ও অনলাইন অ্যাকাউন্ট হাতিয়ে নেয়া (হ্যাকিং) সংক্রান্ত অপরাধ, যা মোট সংঘটিত সাইবার অপরাধের ২১ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আক্রান্তদের ৫৯ ভাগই নারী। গত বছর ২৮ হাজারেরও বেশি ভুক্তভোগী সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন। এসব ভুক্তভোগীর মধ্যে মাত্র ৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ মামলা করেছেন। তবে প্রকৃত অপরাধের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে অপপ্রচার সংক্রান্ত সাইবার অপরাধের শিকার বেশি হচ্ছেন নারীরা। পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত সাইবার অপরাধেও নারী ভুক্তভোগী বেড়েছে। গবেষণা অনুযায়ী, আইনের আশ্রয় নেন না ৮৮ শতাংশ ভুক্তভোগী। ৭০ শতাংশ শিকার হচ্ছে মানুষের ভুলের কারণে। সবচেয়ে বেশি ৭৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সিরা। মাত্র ১২ শতাংশ ভুক্তভোগী সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে আইনগত পদক্ষেপ নেন। বাকি ৮৮ শতাংশ ভুক্তভোগী আক্রান্ত হয়েও তা লুকিয়ে রাখেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছেন এমন অপরাধের ধরন সবচেয়ে বেশি। হ্যাকিংয়ের শিকারের হার ২১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। দেশে পর্নোগ্রাফির মতো অপরাধ প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলছে, যার হার হলো ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

সিক্যাফের জরিপে দেখা যায়, দেশের ৪৭ দশমিক ৭২ শতাংশ সাইবার অপরাধের শিকার হওয়া মানুষ সামাজিক মর্যাদাহানির কথা বলেছেন। ভুক্তভোগী বলেছেন, তারা সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়েছে সামাজিক যে মার্যাদা ছিল তা হারিয়েছেন। এছাড়া আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন ৪০ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোক্তভোগী। সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে অনেকেই মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তসহ চরম অসহায় জীবনযাপন করছেন। এই অপরাধের ভুক্তভোগীদের শিক্ষিত বিবেচনার মধ্যে এইচএসসি পাস ৪০ দশমিক ৯০ শতাংশ। এছাড়া ২১ দশমিক ২১ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী। আর কমপক্ষে এসএসসি পাস ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। বাকি ১২ দশমিক ৮৭ শতাংশ মাধ্যমিক স্তর পেরোতে পারেননি।

তথ্য-প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে সীমিত অভিজ্ঞতার কারণে এই অপরাধ বেড়েই চলছে বলে মনে করেন সিক্যাফ প্রতিষ্ঠাতা ও আহ্বায়ক কাজী মুস্তাফিজ। তিনি জানান, সহজে হাতের কাছে ইন্টারনেট পাওয়ার কারণে ইন্টারনেটের অপব্যবহার বাড়ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাইবার হামলায় শিকার হন। সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র ওষুধ হলো সচেতনতা বাড়ানো। প্রযুক্তির সুবিধাগুলো ভোগ করার পাশাপাশি এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে প্রতিটি পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।

আইনি ব্যবস্থা নেন না ৭৮ শতাংশ নারী : পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি (আড়িপাতা) শাখার পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ) ইউনিট তথ্যমতে, ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের শিকার হওয়ার অভিযোগের মধ্যে ৩৯ শতাংশ নারী। এর মধ্যে ২২ শতাংশ নারী পদক্ষেপ নিলেও ৭৮ শতাংশই কোনো আইনি পদক্ষেপ নেননি। বরং নিজেদের আইডি বন্ধ বা কনটেন্ট (বিষয়বস্তু) মুছে ফেলতেই বেশি আগ্রহী বেশি তারা। পিসিএসডব্লিউর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সেবাপ্রত্যাশীদের মধ্যে ৩৫ হাজার ৫২৫ জন নারী সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার হয়ে সহায়তা নিয়েছেন। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৩১২টি অভিযোগ পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ব্যক্তিগত ছবি, মোবাইল ফোন নম্বর, বাসার ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা কোনো পরিচিতিমূলক তথ্য অর্থাৎ ডক্সিংয়ের মাধ্যমে তথ্য ফাঁস করার। এ ধরনের ৫ হাজার ২৪১টি অভিযোগ জমা পড়ে, যা মোট অভিযোগের ৩৯ শতাংশ। এছাড়া ২ হাজার ৫২০ জন আইডি হ্যাকড হওয়ার শিকার, যা মোট অভিযোগের ১৯ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, চারটি ধারা ছাড়া সাইবার অপরাধ আইন-২০১৩ এর সব ধারা হ্যাকিংয়ের আওতায় থাকলেও তা জামিনযোগ্য। এতে অনেক অপরাধীকে শস্তির আওতায় আনতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা দেরিতে অভিযোগ করাটাও বড় একটি সমস্যা। এতে আইনের সুরক্ষা দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া দেশে শিশু পর্নোগ্রাফি বাড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ছে। এটা রুখতে সবার সচেতনতা জরুরি। প্রযুক্তির ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সঠিক মনিটরিংয়ের পাশাপাশি বাবা-মা ও অভিভাবকদের সচেতন ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হক। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে এই ধরনের অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। সাইবার অপরাধের ব্যাপারে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পরিবারকেই এগিয়ে আসতে হবে। নারীদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে তাদের সামাজিক দক্ষতা বাড়ানো গেলে এ ধরনের অপরাধ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

অনলাইন ব্যবহারকারীদেরও সতর্ক হতে হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আইটি বিশেষজ্ঞরা। নিজের ফেসবুক, ই-মেইল আইডি সুরক্ষিত রাখতে নিয়মিত পাসওয়ার্ড বদলানো এবং এ ধরনের গোপনীয় তথ্য কারো সঙ্গে শেয়ার না করার পরামর্শ দেন তারা।

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, সাইবার জগতে আর্থিক প্রতারণার মূল কারণ ভুয়া এনআইডি দিয়ে বিকাশ, নগদ ও রকেট অ্যাকাউন্ট খোলা। ফলে তাকে নির্ণয় করা কঠিন হয়ে যায়। তাই অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক হতে হবে কেউ যেন ভুয়া এনআইডি দিয়ে তা খুলতে না পারে। মানুষকে সতর্ক হতে হবে, যেন ওটিপি কোথাও শেয়ার না করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হয়েছে। এখন এর দক্ষ ব্যবহার দরকার। দেশে ৭০ শতাংশ সাইবার আক্রমণ হচ্ছে মানুষের ভুলে। সবার সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। আমদানি নির্ভর হওয়ার পরিবর্তে সাইবার সুরক্ষায় ব্যবহৃত সফটওয়্যার ও অ্যাপ্লিকেশন তৈরিতে মনোযোগী হতে হবে। এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিতে হবে যাতে এর দ্বারা কারো ক্ষতি না হয়। এ জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। যারা তরুণ উদ্যোক্তা ও নতুন কিছু করতে চায়; তাদের প্রণোদনা দেয়া দরকার- যাতে সাইবার অপরাধের শিকার হতে না হয়। সেই সঙ্গে উৎকর্ষতা অর্জনে পারস্পরিক সহযোগিতা করতে হবে।

সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মো. তৌহিদুল হক বলেন, কিশোররা ভিডিও টেকনোলজির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টা তার কাছে ডিভাউস থাকে। মানুষ সচেতন না হলে এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে সতর্ক না হলে এ ধরনের প্রতারণা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।