নারীর সম্পত্তির অধিকার ও ইসলাম

নারীর সম্পত্তির অধিকার ও ইসলাম

ফাইল ছবি

নাজমুল হাসান বিন নিজাম   

মানব সমাজ নারী পুরুষের একটি সংমিশ্রিত রূপ। ইসলামের আগমণের আগে পৃথিবীতে নারী ছিল লাঞ্ছনার প্রতীক। ইসলাম কন্যা সন্তানকে অভিহিত করেছে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তিনটি কন্যা সন্তান লালন-পালন করেছে, পুত্র সন্তানকে কন্যাদের ওপর প্রাধান্য দেয়নি, তাদেরকে উত্তম আদশ শিক্ষা দিয়েছে, তাদেরকে বিয়ে দিয়েছে, তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করেছে, সে জান্নাত লাভ করবে। (আবু দাউদ: ৫১৪৯)। নারী পরম শ্রদ্ধেয় মা, আদরের বোন, প্রেমময় স্ত্রী কিংবা পরম স্নেহভাজন কন্যা হিসেবে পুরুষের চিত্তজগৎকে আলোকিত করে। অঘোষিতভাবে মহান আল্লাহর সৃষ্টির সহজাত প্রক্রিয়ায় নারী ব্যতীত বা নারীর সক্রিয় উপস্থিতি ছাড়া একটি সুন্দর, ভারসাম্যপূর্ণ ও সৃজনশীল সমাজ আশা করা যায় না। তাই ইসলাম নারীকে শুধু সামাজিক মর্যাদাই দেয়নি দিয়েছে অর্থনৈতিক অধিকারও। ইসলামপূর্ব সমাজে যৌতুকে অভিশাপ থাকলেও ইসলামে যৌতুক নামে কোনো অধ্যায় নেই। অধিকন্তু বিয়েতে যৌতুকের সম্পূর্ণ উল্টো ব্যবস্থা করেছে ইসলাম। পুরুষদের কষ্টার্জিত অর্থ বিয়েতে বাধ্যতামূলকভাবে তুলে দিতে হয় নারীর হাতে। সর্বোপরী ইসলাম উত্তরাধিকারে নারীকে যথাযথ অধিকার প্রদান করেছে।

ইসলামের আগমনের আগে নারীর সম্পত্তির অধিকার ছিল না। সভ্যতার দাবিদার ইংল্যান্ডে ডাইনি বলে নারীকে পুড়িয়ে মারার আইন রদ করা হয় ১৭৩৬ সালে। যারা আজ সারা বিশ্বের প্রগতি ও আধুনিকতার নিয়ে চিৎকাররত ব্রিটেনে নারীর অবস্থা ছিল খুবই করুণ! Married Women's Property Act : ১৮৮২ –এর আগ পর্যন্ত সেদেশের আইনে নারীদের নারীর সম্পত্তি ছিল অবৈধ। বিয়ের আগেও যদি কোনো নারী চাকরি বা অন্য কোনো কাজ করে অর্থ উপার্জন করত তাহলে তার বিয়ে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব সম্পত্তির মালিক হয়ে যেত তার স্বামী। জার্মানী নারীদের ১৯০০ সাল, সুইস নারীদের ১৯০৭, অষ্ট্রেলীয় নারীদের ১৯১৯ সালের আগে ছিল না কোনো উত্তরাধিকার সম্পত্তি। অথচ ইসলামের নবী, বিশ্বমানবতার পরম বন্ধু হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ‘সভ্য পৃথিবীর’ও ১৩০০ বছর আগে মরুভূমির প্রান্তে দাঁড়িয়ে উত্তরাধিকারসহ সম্পত্তিতে নারীর অধিকারের কথা ঘোষণা করেছিলেন দীপ্তকণ্ঠে। একজন পূর্ণ বয়স্ক মুসলিম নারী, তিনি বিবাহিত হন বা নাই হন, কারো সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই সম্পদের মালিক হতে পারেন, মালিকানা হস্তান্তরও করতে পারেন। রয়েছে তার মাতাপিতার পরিত্যক্ত স্পত্তিতে ন্যয়সঙ্গত অধিকার।

উত্তরাধিকারে নারীর অধিকারের কথা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে পবিত্র কোরআন। যদি কোনো নারীর কোনো ভাই না থাকে তাহলে তিনি (একা হলে) পিতার ত্যাজ্য সমুদয় সম্পত্তির অর্ধেক পাবেন। আর যদি তারা দুই বোন বা ততধিক হন এবং কোনো ভাই না থাকে তাহলে তারা তাদের পিতা/মাতার সমুদয় সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ পাবেন। যদি এক বোন এবং এক ভাই হয় তাহলে একজন ভাইয়ের অংশের অর্ধেক পাবেন একজন বোন। অর্থাৎ যদি কেউ এমতাবস্থায় মারা যায় যে তার এক পুত্র ও এক কন্যা (আর কোনো উত্তরাধিকারী নেই)। তাহলে সমুদয় সম্পত্তি তিন ভাগে ভাগ করে দুই ভাগ পাবে পুত্র আর এক ভাগ পাবে কন্যা। এক পুত্র ও দুই কন্যা থাকলে সমুদয় সম্পত্তি চার ভাগে ভাগ করে দুই ভাগ পাবেন পুত্র। আর বাকি দুই ভাগ পাবেন দুই কন্যা (প্রত্যেক কন্যা এক ভাগ করে)। পবিত্র কোরআনুল কারিমে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেন: একজন পুরুষের অংশ দু’জন নারীর সমান। আর যদি শুধু নারীই হয় দু-এর অধিক, তাহলে তাদের জন্যে ওই ত্যাজ্য মালের তিন ভাগের দুই ভাগ। আর যদি (কন্যা) একজনই হয় তাহলে সে জন্য অর্ধেক।’ (সুরা নিসা: ১১)।

স্বামীর পরিত্যক্ত সম্পত্তিতেও রয়েছে নারীর অধিকার। খ্রিষ্টান ধর্মে পিতার মৃত্যুর পর যদি তার কোনো পুত্র সন্তান জীবিত থাকে তবে কন্যা পৈতৃক সম্পত্তি থেকে কিছুই পাবে না। এ বিষয়টি প্রচলিত বাইবেলে উল্লেখ আছে। পুত্র সন্তান দু’জন হলে বড় পুত্র পাবে ছোটজনের দিগুণ। পুত্র না থাকলে সমস্ত সম্পত্তি কন্যার। কন্যা না থাকলে (মৃতের ) ভায়ের। ভাই না থাকলে নিকটাত্মীয়র। তবুও মৃত ব্যক্তির বিধাবা স্ত্রী কিছুই পাবে না। অথচ ইসলাম স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর অধিকার খুব মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। যদি কারো স্বামীর ইন্তিকাল হয় আর সে স্বামীর কোনো সন্তান না থাকে তাহলে স্বামীর সমূদয় সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ পাবেন। আর যদি স্বামীর সন্তান থাকে তাহলে স্ত্রী পাবেন এক-অষ্টমাংশ (আট ভাগের এক ভাগ)। পবিত্র কোরআনুল কারিমে এরশাদ হয়েছে, ‘স্ত্রীদের জন্য তোমাদের ত্যাজ্য সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ যদি তোমাদের কোনো সন্তান না থাকে। আর যদি তোমাদের সন্তান থাকে তাহলে তাদের জন্য হবে ওই সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ।’। (সুরা নিসা: ১২)।

সন্তানদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতেও রয়েছে মায়ের অধিকার। মা জীবিত থাকা অবস্থায় সন্তানের ইন্তিকাল হলে সন্তানের যদি কোনো সন্তান-সন্ততি না থাকে তাহলে সেই সন্তানের সম্পদের এক- তৃতীয়াংশ পাবেন মা। আর যদি মৃত সন্তানের কোনো সন্তান-সন্ততি থাকে তাহলে মা সেই (মৃত) সন্তানের সম্পত্তির একশষ্টমাংশ (ছয় ভাগে এক ভাগ) পাবেন। পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘মৃতের কোনো পুত্র থাকলে পিতা-মাতার প্রত্যেকের জন্য (সন্তানের) ত্যাজ্য সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ। যদি পুত্র না থাকে এবং পিতা-মাতাই ওয়ারিশ হয়, তবে মাতা পাবেন তিন ভাগের এক ভাগ।’। (সুরা নিসা: ১১)। এভাবেই ইসলাম সম্পত্তিতে ও উত্তরাধিকারে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক