দেশে ফিরতে মরিয়া লেবানন প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক

দেশে ফিরতে মরিয়া লেবানন প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক

বেরুত বিস্ফোরণে বন্দরে অবস্থিত খাদ্য গুদাম ধ্বংস হয়ে যায়। ছবি: রয়টার্স

লেবাননে অবস্থানরত হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক দেশে ফিরে আসার জন্য বৈরুতের দূতাবাসে আবেদন করলেও তাদের ফেরানোর ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত কোন তথ্য দিতে পারছে না সরকার।

প্রবাসী এই শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের পাশাপাশি আলোচনা চলছে বলে দূতাবাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

গত এক বছরের বেশি সময় ধরে লেবাননে রাজনৈতিক সংকট ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এবং সর্বশেষ বৈরুত বিস্ফারণের পর এক প্রকার কর্মহীন অবস্থায় রয়েছেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা। এমন পরিস্থিতিতে অর্ধাহারে এবং অনাহারে থাকার কথা জানিয়ে প্রবাসী শ্রমিকরা বাংলাদেশে ফেরত আসতে চাইছেন।

লেবাননের বৈরুত শহরে গত তিন বছর ধরে একটি হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করছেন চট্টগ্রাম ফটিকছড়ির বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী হোসেন।

প্রথম দুই বছর বেশ ভালো উপার্জন করলেও চলতি বছরের করোনাভাইরাস মহামারি তার ওপর গত আগস্টে বৈরুতের ভয়াবহ বিস্ফোরণে তার মতো বহু প্রবাসী বিপর্যয়ের মুখে পড়েন।

ওই বিস্ফোরণে দেশটির খাদ্য গুদাম ছাই হয়ে যাওয়ায় খাদ্যে আমদানি নির্ভর এই দেশটিতে চরম খাদ্য সংকট দেখা দেয়।

অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাংলাদেশিরা চাকরি হারাতে থাকেন। আবার যাদের চাকরি আছে লেবানিজ মুদ্রার মান হু হু করে পড়ে যাওয়ায় তারাও চলতে পারছেন না।

সীমাহীন কষ্ট
হোসেন জানান, আগে যে বেতন পেতেম সেটা লেবানিজ মুদ্রা থেকে ডলারে এরপর টাকায় ভাঙানোর আগে যে পরিমাণ টাকা পেতেম, এখন পাই তার আট থেকে নয় ১০ গুণ কম। অনেকে টিকে থাকতে বাধ্য হয়ে দেশ থেকে টাকা আনছেন।

“আগে বেতন ভাঙ্গায় ৩২ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা পাইতাম এখন পাই ৪ হাজার টাকা,''

''এই টাকায় বাড়িভাড়া দিব কি, খাব কি, দেশে পাঠাবো কি। দেশ থেকে টাকা আনতে আনতে বাড়ি বিক্রি করতে হইসে। এইভাবে তো চলে না।”

এমন অবস্থায় লেবাননে অবস্থানরত সীমাহীন কষ্টে থাকা বাংলাদেশি কর্মীরা জরিমানা গুনে হলেও দেশে ফিরতে মরিয়া।

“যাদের চাকরি নাই তারা রাস্তাঘাটে বোতল টোকায় বিক্রি করে চলে, অনেকে ভিক্ষা করে। এর চাইতে দেশে থাকলে কিছু কর্ম করে খাইতে পারবো। আমরা দেশে ফিরতে চাই। কিন্তু অ্যাম্বাসিতে গেলে আমাদের কথা ওরা শুনতেই চায় না। দুর্ব্যবহার করে।”

সরকারি সূত্রমতে, প্রায় ৪০ লাখ জনসংখ্যার লেবাননে বৈধ অবৈধ মিলে অন্তত দেড় লাখ বাংলাদেশি কাজ করেন। বিভিন্ন বাসবাড়িতে নারী শ্রমিক, গৃহকর্মী হিসেবে আর বেশিরভাগ পুরুষ পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন।

গত এক বছরের বেশি সময় ধরে লেবাননে রাজনৈতিক সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রার মান পড়ে যাওয়া, এক কথায় অর্থনৈতিক মন্দার কবলে রয়েছে। তার মধ্যে করোনাভাইরাস মহামারী এবং সবশেষে বৈরুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়।

এ কারণে দেশটিতে থাকা হাজার হাজার বাংলাদেশি কর্মী, বাংলাদেশে ফিরতে বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাসে আবেদন করেছে বলে জানিয়েছেন দূতাবাসের শ্রম কল্যাণ উইং এর প্রথম সচিব আবদুল্লাহ আল মামুন।

তবে এসব আবেদন কবে গ্রহণ করে শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো হবে, সেটা আলোচনার ভিত্তিতে শিগগিরই জানানো হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

মি. মামুন বলেন, “এ বছর আমরা সাড়ে ছয় হাজার কর্মীকে ফেরত পাঠিয়েছি। আগে যারা আবেদন করেছিল তাদের সবাইকে পাঠানোই শেষ হয় নাই। তার ওপর হাজার হাজার মানুষকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হুট করে নেয়া যায় না। এজন্য পরিকল্পনা লাগে। এর সাথে দুই দেশের সরকার, দূতাবাস, এয়ারলাইন্স সবকিছু জড়িত। আমরা আবেদন পাচ্ছি। "

এটা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।”

যেসব শ্রমিকের কোন বৈধ কাগজপত্র নেই দূতাবাস তাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে কোন দায়িত্ব নিচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলে গত কয়েক দিন ধরে দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ করে আসছে ভুক্তভোগীরা।

এমন পরিস্থিতিতে লেবাননে আটকা পড়া শ্রমিকদের বিশেষ ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানিয়েছেন রামরুর প্রেসিডেন্ট তাসনিম সিদ্দিকী। লেবানন সরকারের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে দ্রুত চুক্তি করা এবং এসব শ্রমিককে বাংলাদেশ বিমানের চার্টার্ড ফ্লাইটে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করছেন।

মিস সিদ্দিকী বলেন, “ওই দেশের সরকারের সাথে আলোচনা করে দ্রুত এই কর্মীদের দেশে আনতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। বিদেশে আটকে পড়া শ্রমিকদের এর আগে বাংলাদেশের বিমানে করে ফেরত আনা হয়েছে। এবারো তাই করতে হবে।”

তবে চার্টার্ড বিমানের ভাড়া যেহেতু অনেক বেশি, নিঃস্ব শ্রমিকদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। তাই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়, জরুরি তহবিল থেকে সেটার ব্যবস্থা করতে হবে বলে তিনি জানান।

তবে এখনও লেবাননের বেশিরভাগ কর্মী দেশে ফিরতে চাইছেন না। অনেক টাকা খরচ করে দেশে পাড়ি জমানোয় এবং অনেকের এখনো দেনা শোধ না হওয়ায় তারা অপেক্ষা করছেন কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। 
সূত্র: বিবিসি