কুরবানির ইতিহাস ও শিক্ষা

কুরবানির ইতিহাস ও শিক্ষা

ফাইল ছবি

মানব সৃষ্টির ইতিহাসের ন্যায় কুরবানির ইতিহাসও অতি প্রাচীন। পবিত্র কুরআনুল কারিমের সূরা মায়েদার ২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সে ঘটনা এভাবে তুলে ধরেছেন-وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَاناً فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنْ الآخَرِ قَالَ لأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنْ الْمُتَّقِينَ

আপনি তাদেরকে আদম (আ:)-এর দুই পুত্রের (হাবিল ও কাবিলের) বৃত্তান্ত যথাযথভাবে শোনান। যখন তারা উভয়ে কুরবানি করেছিল। তখন একজনের কুরবানী কবুল হল এবং অন্য জনের কুরবানি কবুল হল না। (তাদের একজন) বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। (অপরজন) বলল, আল্লাহ তো সংযমীদের কুরবানিই কবুল করে থাকেন।’ 

সূরা মায়েদার ২৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,لَئِنۡۢ بَسَطۡتَّ اِلَیَّ یَدَکَ لِتَقۡتُلَنِیۡ مَاۤ اَنَا بِبَاسِطٍ یَّدِیَ اِلَیۡکَ لِاَقۡتُلَکَ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اللّٰهَ رَبَّ الۡعٰلَمِیۡنَ
সে (হাবিল) বলল, যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হাত প্রসারিত কর, তবুও আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার দিকে হাত প্রসারিত করব না। কেননা আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।’ 

মহাগ্রন্থ আল কুরআনের উল্লিখিত আয়াত দুটির আলোকে বলা যায় জগৎ সৃষ্টির শুরুর দিকেই কুরবানির প্রচলন শুরু হয়েছে। তারপর সকল নবী-রাসূলদের সময়ে এ বিধান বিদ্যমান ছিল। যুগে যুগে সব জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষ আল্লাহকে সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তার প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করতেন। এ কথার প্রমাণে মহান আল্লাহ সূরা হজে¦র ৩৪ নম্বর আয়াতে বলেন-وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكاً لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرْ الْمُخْبِتِينَ
‘আমি প্রতিটি সম্প্রদায়ের জন্য (কুরবানির) নিয়ম করে দিয়েছি। তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যে রিজিক দেওয়া হয়েছে সেগুলোর উপর তারা যেন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে । কারণ তোমাদের মাবুদই একমাত্র উপাস্য। কাজেই তাঁর কাছেই আত্মসমর্পণ কর আর সুসংবাদ দাও সেই বিনীতদেরকে।’ 

বর্তমান কুরবানির ঘটনা:
সমগ্র বিশে^র মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর জিলহজ¦ মাসের ১০ তারিখ যে কুরবানি দিয়ে থাকেন; সেটা মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ:) থেকে প্রচলিত। আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহীম (আ:) কে প্রিয় সন্তান হযরত ইসমাঈল (আ:) কে কুরবানির নির্দেশ দিয়েছিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ:) সে হুকুম পালন করে সফল হয়েছিলেন। সেই থেকে মুসলিম জাতি কুরবানির এ বিধান পালন করে আসছেন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা সাফ্ফাত এর ১০২ নম্বর আয়াতে এভাবে তুলে ধরেছেন-فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعۡیَ قَالَ یٰبُنَیَّ اِنِّیۡۤ اَرٰی فِی الۡمَنَامِ اَنِّیۡۤ اَذۡبَحُکَ فَانۡظُرۡ مَاذَا تَرٰی قَالَ یٰۤاَبَتِ افۡعَلۡ مَا تُؤۡمَرُ سَتَجِدُنِیۡۤ اِنۡ شَآءَ اللّٰهُ مِنَ الصّٰبِرِیۡنَ
‘অতঃপর যখন সে তার সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন সে বলল, ‘হে প্রিয় বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি, অতএব দেখ তোমার কী অভিমত?; সে বলল, ‘হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তাই করুন। আমাকে ইনশাআল্লাহ আপনি অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ 
এর পরের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,فَلَمَّاۤ اَسۡلَمَا وَ تَلَّهٗ لِلۡجَبِیۡنِ
‘অতঃপর বাবা-ছেলে উভয়েই যখন আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহিম (আ:) তাকে জবেহ করার জন্য কাত করে শুইয়ে দিলেন।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০৩)
হযরত ইব্রাহীম (আ:) যখন আল্লাহ তায়ালা পক্ষ থেকে দেখানো স্বপ্ন বাস্তবায়ন করলেন তখন তিনি সন্তুষ্ট হয়ে গেলন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, قَدۡ صَدَّقۡتَ الرُّءۡیَا اِنَّا کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡمُحۡسِنِیۡنَ - وَ نَادَیۡنٰهُ اَنۡ یّٰۤاِبۡرٰهِیۡمُ
‘তখন আমি ডেকে বললাম, ‘হে ইবরাহিম! তুমি তো স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে দেখালে। নিশ্চয়ই আমি এইভাবে সৎকর্মপরায়ণদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০৪-১০৫)
আল্লাহ তায়ালা তখন সন্তানের পরিবর্তে চতুষ্পদ জন্তু জবেহের ব্যবস্থা করেন। আল্লাহ তায়ালা এভাবে উল্লেখ করেছেন-اِنَّ هٰذَا لَهُوَ الۡبَلٰٓـؤُا الۡمُبِیۡنُ - وَ فَدَیۡنٰهُ بِذِبۡحٍ عَظِیۡمٍ
‘নিশ্চয়ই এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তার (সন্তান কুরবানির) পরিবর্তে জবেহযোগ্য এক মহান জন্তু দিয়ে (কুরবানি করিয়ে) তাকে (সন্তানকে) মুক্ত করে নিলাম।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০৬-১০৭)
وَ تَرَکۡنَا عَلَیۡهِ فِی الۡاٰخِرِیۡنَ
আর এ (কুরবানির) বিষয়টি পরবর্তীদের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম। (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০৮)

হযরত ইব্রাহীম (আ:) কে আল্লাহ তায়ালা প্রিয় সন্তান কুরবানির নির্দেশ দিয়েছেন। তিনিও তাঁর নির্দেশ পালন নিজ সন্তানকে জবেহ করার জন্য শুইয়ে দিয়েছেন। আর তিনি এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তারপর থেকেই মুসলিম উম্মাহ কুরবানির এ বিধান পালন করে আসছেন। কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা এ বিধান মানুষের মাঝে কায়েম রাখবেন। 

কুরআন ও হাদীসে কুরবানি শব্দের ব্যবহার যেভাবে: 
কুরবানি (قربانى) শব্দটি উর্দু ও ফারসি ভাষায় ব্যবহৃত। আরবী শব্দ (قرب বা قربان) যার অর্থ হলো-নৈকট্য বা সান্নিধ্য। 
পবিত্র কুরআনের সূরা ইখলাসে কুরবানিকে نحر অর্থে (রক্ত প্রবাহিত) ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ । এ জন্য কুরবানির দিনকে يوم النحر বলা হয়।

এছাড়াও পবিত্র কুরআনে কুরবানিকে نسك অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ ‘আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু; সবই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার জন্য।’ (সুরা আনআ’ম : আয়াত ১৬২)
অন্যত্রে কুরবানিকে منسك অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘ لِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكاً ‘আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্য কুরবানির বিধান রেখেছি।’ (সুরা হজ্জ : আয়াত ৩৪)।

পবিত্র হাদীস শরীফে কুরবানিকে الاضحى (যবেহ) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এ জন্য কুরবানির ঈদকে (عيد الاضحى) ‘ঈদ-উল-আজহা’ বলা হয়।

কুরবানির শিক্ষা: 
কুরবানীতে যেমনি রয়েছে ফজিলত তেমনি রয়েছে মুমিনের জন্য অসংখ্য শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে। ত¤েœধ্যে কতিপয় উল্লেখ করা হল। 

বিশ্বব্যাপী তাওহীদ প্রতিষ্ঠা: মহান আল্লাহর তাওহীদ বা একত্ববাদ বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করা কুরবানীর অন্যতম শিক্ষা। কারণ, একমাত্র বিশ্বজাহানের মালিক মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে, তার নামেই পশু কুরবানী দেয়া হয়। যা পূর্বোল্লিখিত সূরা হজে¦র ৩৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। জগতের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা যেখানে তাদের  দেব-দেবির নামে উৎসর্গ করে, সেখানে মুসলিম সমাজ কুরবানি দেয় একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে।

আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমার্পণ: কুরবানির গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমার্পণ। আল্লাহর সকল আদেশের সামনে বিনা প্রশ্নে মাথানত করে দেয়াই হল পূর্ণ আত্মসমার্পণের সমুজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ। ঈদুল আযহার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমরা হযরত ইব্রাহীম (আ:) ও তদ্বীয় পুত্র ঈসমাইল (আ.)এর এরূপ পুর্ণ আত্মসমার্পণের চিত্রই পবিত্র কুরআনুল কারীমে দেখতে পাই।

ইখলাস বা একনিষ্ঠতা: সকল কাজে ইখলাস বা একনিষ্ঠতাই ইসলামের মহান শিক্ষা। ইখলাস ছাড়া পরকালীন কোনো কাজই আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন না। আন্তরিকতা ও মহব্বতবর্জিত ইবাদত প্রাণহীন কাঠামো মাত্র। তাই কুরবানিও একমাত্র আল্লাহ তায়ালার রেজাবন্দী হাসিলের জন্য দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِن يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ

 ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালার নিকট কুরবানীর পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না। তার নিকট তোমাদের তাকওয়া (ইখলাস) পৌঁছে’। (সূরা হাজ্জ্ব-৩৭)। ইখলাসপূর্ণ কুরবানী হওয়ার কারণেই আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর কুরবানী কবুল করে নিয়েছিলেন।

তাকওয়াভিত্তিক জীবন-যাপন: কুরবানীর সুমহান দীক্ষা তাকওয়াভিত্তিক জীবন-যাপন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনই মুমিনের প্রকৃত সফলতা। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা তার আমলকেই কবুল করেন, যার আমলে তাকওয়া বা খোদাভীতির সন্নিবেশন ঘটেছে। আদমপুত্র হাবিলের কুরবানী আল্লাহ তায়ালা কবুল করেছিলেন তাকওয়ার প্রভাবের কারণেই।

দরিদ্র ও অনাথের সুখে-দুঃখে অংশীদার: কুরবানীর অন্যতম শিক্ষা দরিদ্র ও অনাথের সুখ-দুঃখে ভাগীদার হওয়া। ঈদুল আযহার নামাজে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের সহাবস্থানের পাশাপাশি আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্র-অনাথের মাঝে কুরবানীর গোশত বণ্টন আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, আমাদের সম্পদে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের অধিকার রয়েছে।

প্রিয় বস্তু আল্লাহর জন্য ব্যয় করা: হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর বয়স যখন ১০০ বছর তখন তিনি প্রাণাধিক প্রিয় হযরত ইসমাঈল (আ:) কে আল্লাহর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কুরবানি দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠবোধ করেননি। এ থেকে বোঝা যায় আল্লাহ বান্দার প্রিয় বস্তু ব্যয়ের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্ট হন। 

পরিশেষে বলা যায়, কুরবানী মুসলমানদের শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং পরিশুদ্ধ জীবন গঠনের নিয়মতান্ত্রিক অনুশীলনও বটে। এর মাধ্যমে মুসলমান তাওহীদী আদর্শে উজ্জীবীত হয়ে ইখলাস, তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমার্পণের অপূর্ব নজির স্থাপন করতে পারে।

রচনা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অধিকারী

মুছাব্বিহা আফিফা
দাখিল দশম শ্রেণী

খানপুর সিদ্দিকিয়া আলিম মাদরাসা