পানের যত ভেষজ গুণ

পানের যত ভেষজ গুণ

সংগৃহীত

প্রাচীন ভেষজ গ্রন্থ আয়ুর্বেদে পানের বিভিন্ন উপকারিতার কথা বলা হয়েছে। উপমহাদেশে প্রাচীনকাল থেকে পান খাওয়ার রীতি চালু আছে। পানের মধ্যে বেশ কিছু ঔষধি গুণ আছে। এছাড়াও এটা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট,একই সঙ্গে কামোদ্দীপক,এবং প্রাকৃতিক মাউথ ফ্রেশনার। পান পাতার এত গুণ আছে যে সবারই রোজ এটা খাওয়া উচিত। বাংলাদেশেসহ প্রধানত দক্ষিণ এশিয়া, উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষ পান খায়। অনেক মানুষ নিশ্বাসকে সুরভিত করা এবং ঠোঁট ও জিহবাকে লাল করার জন্য পান খায়। কেবল স্বভাব হিসেবেই নয়, বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে সামাজিক রীতি, ভদ্রতা এবং আচার-আচরণের অংশ হিসেবেই পানের প্রচলন অনেকদিন থেকে চলে আসছে।

স্বাস্থ্যের পক্ষে বেশ উপকারি পান। চলুন জেনে নেওয়া যাক পানের উপকারী দিকগুলো :-

১) মুখের দুর্গন্ধ দূর করে :

খাবার গ্রহণের পর তার কণা মুখের ভেতরে, দাঁতের ফাঁকে লেগে থাকে। এগুলো ব্যাকটেরিয়া পচিয়ে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে। পান খেলে তার রস জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে এসব ব্যাকটেরিয়াকে জন্মাতে দেয় না। ফলে মুখের স্বাস্থ্য ভালো থাকে ও মুখে দুর্গন্ধ হয় না।

২) হজমে সাহায্য করে :

পান খেলে লালাগ্রন্থির নিঃসরণ বেড়ে যায়। লালার মধ্যে থাকা বিভিন্ন এনজাইম বা উৎসেচক খাদ্যকে কণায় ভাঙতে সাহায্য করে যার ফলে হজম ভালো হয়। শুধু পান পাতা চিবিয়ে খেলেও এ উপকার পাওয়া যায়। বিশেষ করে ভারী খাবার খাওয়ার পর অনেকেরই হজমের সমস্যা হয়। এজন্য যে কোনো উৎসব ও অনুষ্ঠানে খাবার পরিবেশনের শেষে পান পরিবেশন করা হয় যা খেলে ওসব খাবার দ্রুত হজম হয়ে যায়। বদহজম হলে পানিতে পান পাতা টুকরো করে কেটে কিছুক্ষণ সিদ্ধ করতে হবে। সিদ্ধ করার সময় তাতে কয়েকটা গোলমরিচ দিতে হবে। তারপর তা নামিয়ে ছাঁকে ও ঠাণ্ডা করে তা খেতে হবে। শিশুদের ২ চা চামচ খাওয়াতে হবে। এতে হজম ভালো হবে, বদহজম বা অজীর্ণ হলে সেটাও চলে যাবে।
৩) যৌন শক্তি বাড়ায় :

এটি একটি পুরনো প্রথা, তবু কার্যকর। নববিবাহিত দম্পতিদের অনেকেই যৌন মিলনে যাওয়ার আগে পান খান। এতে তাদের যৌন ক্ষমতা ও মিলনের স্থায়িত্বকাল বৃদ্ধি পায়।

৪)  প্রস্রাবে সাহায্য করে :

কিডনির রোগ আছে যাদের তাদের প্রস্রাব করতে কষ্ট হয়। এই কষ্ট কমাতে সাহায্য করে পান পাতা। শরীর থেকে দ্রুত পানি বের করে দেওয়ার ক্ষমতা আছে পান পাতার। দুধের সঙ্গে পান বেটে খেলে এই ব্যাপারে উপকার পাবেন।

৫) জন্মরোধ করে :

পান গাছের শিকড় বেটে রস করে খেলে ছেলেপুলে হয় না। জন্ম নিরোধক বড়ি না খেয়েও জন্মনিয়ন্ত্রণে এটা সেবন করা যায়। বিভিন্ন দেশের গবেষণায় এর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

৬) উঁকুন সমস্যা দূর করে :

মাথায় উঁকুন হলে গোসলের কিছুক্ষণ আগে পান পাতার রস মাথায় লাগিয়ে বসে থাকলে উঁকুন সবংশে মরে যায়। এ কাজে ঝাল পান হলে ভালো হয়।

৭) ফোঁড়া সমম্যা :

পান পাতার চকচকে সবুজ পিঠে ঘি মাখিয়ে একটু সেঁক দিয়ে গরম করে ফোঁড়ার ওপর লাগিয়ে দিলে দ্রুত ফোঁড়া পেকে ফেটে যায়। আবার পাতার উল্টো পিঠে ঘি মাখিয়ে একইভাবে বসিয়ে রাখলে তা পুঁজ টেনে বের করে আনে। ঘিয়ের বদলে ক্যাস্টর অয়েল ব্যবহার করেও একই ফল পাওয়া যায়।

৮) কান পাকা সমস্যা :

কান পেকে পুঁজ হয়ে গেলে সেসব কানে পান পাতার রস গরম করে ১-২ ফোঁটা কানের ভেতরে দিলে এ সমস্যা চলে যায়।

৯) অ্যান্টিসেপ্টিক হিসেবে ব্যবহার : 

ছোটখাটো কাটা ছেড়ায় পান বেটে লাগিয়ে দিতে পারেন। এছাড়াও যাদের আর্থারাইটিস আছে তাদের ব্যথা কমাতেও সাহায্য করে পান পাতা।

১০) ডিওডোরেন্টের কাজ করে : 

গোসল করার পানিতে কিছুটা পান পাতার রস মিশিয়ে নিন। এই পানিতে দিয়ে গোছল করলে সারাদিন ফ্রেশ লাগবে। এছাড়াও ঘাম কম হবে। পান পাতা দিয়ে পানি ফুটিয়ে ঠান্ডা করে সেই পানি পান করলে ঘামের গন্ধ কমবে। এমনকী এতে মহিলাদের মেনস্ট্রুয়েশন স্মেল ও কমবে।

১১) ভ্যাজাইনাল হাইজিন ঠিক রাখে :

ভ্যাজাইনাল বার্থের পর তাজা পান পাতা ভ্যাজাইনাকে সংকুচিত করতে সাহায্য করে। এছাড়াও ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ বা ভ্যাজাইনাল ইচিং ও সারিয়ে দেয়।

১২) ত্বকের জন্য ভালো :

খুব কম লোকেই জানে পানে যে অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল প্রপার্টি আছে তা পিম্পল, অ্যাকনে সহজেই সারিয়ে তোলে। এছাড়াও বিভিন্ন স্কিন অ্যালার্জি, ফুসকুড়ি, কালো ছোপ, সান বার্ন সারিয়ে দেয়| এর জন্য কয়েকটা তাজা পান পাতা আর কাঁচা হলুদ একসঙ্গে বেটে লাগাতে হবে।

১৩) মাথা ব্যথা কমায় :

গরমের কারণে মাথা ব্যথা করলে কপালে কয়েকটা পান পাতা রাখুন। এছাড়াও পান পাতার রস লাগালে তাড়াতাড়ি মাথা ব্যথা কমে যায়।

১৪) মেটাবলিজম বাড়ায় :

নিয়মিত পান খেলে শরীরের মেটাবলিজম বাড়ে। এর ফলে ব্লাড সার্কুলেশন বেড়ে যায়। যা বিভিন্ন প্রটিন, ভিটামিন, মিনারেল অ্যাবজর্ব করতে সাহায্য করতে।

১৫) খিদে বাড়ায় :

পেটের পিএইচ লেভেল ঠিক করতে সাহায্য করে পানের রস। এর ফলে পেটে বায়ু হয় না এছাড়াও পেট ফাঁপা কমায়। পান পাতা শরীর থেকে টক্সিন বের করতে সাহায্য করে। এর ফলে খিদে বাড়ে।

১৬) চর্মরোগ সারায় :

দেহের কোথাও দাদ হলে বা চুলকানি পাঁচড়া হলে সেখানে ঘষে পান পাতার রস লাগিয়ে দিলে কয়েক দিনের মধ্যে তা সেরে যায়।

১৭) পাইওরিয়া ভালো করে :

দাঁতের মাঢ়ি দূষিত হলে সেখানে ফুলে যায় ও পুঁজ হয়, ক্ষত হয়। এক্ষেত্রে পানের রসের সাথে অল্প পানি মিশিয়ে কুলকুলি করলে সেখান থেকে আর পুঁজ পড়ে না, ধীরে ধীরে ক্ষতও শুকিয়ে যায়। মুখগহ্বরে কোনো ক্ষত হলে পানের রসে তার উপশম হয়। পানের রসে এসকরবিক এসিড আছে যা একটি চমৎকার এন্টিঅক্সিডেন্ট। এটা মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।

১৮) নখকুনির কষ্ট সারায় :

নখকুনিতে নখের কোণায় ব্যথা হয়। এ অবস্থায় সেখানে কয়েক ফোঁটা পানের রস দিলে ব্যথাটা চলে যায়।

১৯) আঁচিল দূর করে :

আঁচিল হলে সে আঁচিলের ওপর কয়েক দিন পানের রস লাগালে তা ধীরে ধীরে খসে পড়ে ও সেখানে আর আঁচিল তৈরি হয় না।

২০) ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে :

পান রক্তে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বলে গবেষণায় জানা গেছে। পানের ডায়াবেটিস প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য আছে।

২১) সর্দি বের করে :

বুকের ভেতর কফ/সর্দি বা শ্লেষ্মা জমা হলে তা বের করতে পানের রস কার্যকর। এ ক্ষেত্রে পানের রসের সাথে মধু মিশিয়ে চেটে চেটে কয়েক দিন খেতে হবে। এতে বুকে জমা কফ বেরিয়ে যাবে।

২২) মাথা ব্যথা দূর করে :

মাথা ব্যথা হলে কপালে পানের রস লেপে দিলে দ্রুত মাথাব্যথা কমে যায়।

২৩) মাউথ ফ্রেশনার :

পান পাতা খাওয়ার ফলে যে রস উত্‍পাদন হয় তা আমাদের দাঁত আর মাড়ি সুস্থ রাখে। এছাড়াও পান পাতার রস আমাদের মুখের ভেতরটা পরিষ্কার রাখে। এমনকী মুখের মধ্যে রক্তপাতও বন্ধ করে। পান বেটে তার রস এক কাপ হাল্কা গরম পানিতে মিশিয়ে রোজ সকালে তা দিয়ে গার্গল করুন। কয়েকদিনর মধ্যেই তফাত দেখতে পাবেন।

২৪) নাক থেকে রক্ত পড়া থামায় : 

অনেক সময় সান স্ট্রোক হওয়ার ফলে নাক দিয়ে রক্ত পড়ে। এটা বন্ধ করতে একটা পান পাতা পাকিয়ে তা নাকের মধ্যে গুঁজে দিন। মাথা পিছনের দিকে হেলিয়ে রাখেতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। আসলে পান পাতা খুব তাড়াতাড়ি রক্ত জমাট বাঁধিয়ে দিতে পারে।

২৫) কানের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে : 

পান পাতার আরো একটা বড় বেনিফিট হল এটা কানের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। কয়েক ফোঁটা পানের রস আর কয়েক ফোঁটা নারকেল তেল একসঙ্গে মিশিয়ে কানের মধ্যে দিলে ব্যথা কমে যাবে। তবে এই ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াই ভালো।

২৬)  অ্যান্টি ফাংগাল :

শরীরের যে সব অংশে ফাংগাল ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যেমন পায়ের আঙুল, প্রভৃতি সেই সব জায়গায় পানপাতার রস লাগান। কয়েকদিনের মধ্যে ইনফেকশন সেরে যাবে।

২৭) সতর্কতা বাড়ায়:

মধুর সঙ্গে পান পাতা বেটে খান। এতে এনার্জি তো ফিরে পাবেনই একই সঙ্গে মেন্টাল ফাংশানিংও জোরদার হবে।

২৮) সর্দি কমায় :

বুকে সর্দি জমে গেলে সর্ষের তেল আর পান পাতা ভালো করে গরম করে বুকে লাগাতে হবে। এছাড়াও ঠান্ডা লেগে সর্দি হলে পান পাতা, এলাচ, লবঙ্গ একসঙ্গে ফুটিয়ে গাঢ় করে খেতে হবে।

২৯) হজমশক্তি বাড়ায় :

সাধারণত খাওয়ার পর পান খাওয়া হয়। এটা করা হয় কারণ পান হজম করতে সাহায্য করে। গ্যাস, অম্বলও কমায়। এছাড়াও যাদের কনস্টিপেশনের সমস্যা আছে তাদের জন্যেও উপকারী। পেট খারাপ হলে পেটে যে ব্যথা করে অনেকসময় তাও কমাতে সাহায্য করে।

৩০) গ্যাস্ট্রিক আলসার নিরাময় করে :

পান খেলে পেটে বায়ু কম হয় ও গ্যাস হয় না। এর ফলে গ্যাস্ট্রিক ও তা থেকে আলসার সৃষ্টির সুযোগ কমে যায়। পানের রস হজমে সাহায্য করায় তা পেটে বদ গ্যাস তৈরি রোধ করে। ফলে পেট ফাঁপে না ও গ্যাস্ট্রিক হয় না।