লবণ বা চিনি যখন মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে

লবণ বা চিনি যখন মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে

লবণ বা চিনি যখন মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে

খাবারের টেবিলে অনেকেরই পাতে অতিরিক্ত লবণ নেয়া বা চায়ের বাড়তি চিনি নেয়ার অভ্যাস রয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বল্প মাত্রার এরকম কাঁচা লবণ বা চিনি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে।মানবদেহের জন্য লবণ বা চিনির প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু তার মাত্রা রয়েছে।

মানুষ প্রতিদিন যে নানা ধরনের খাবার গ্রহণ করে থাকে, তার ভেতরেও লবণ বা চিনির উপস্থিতি থাকে। একজন মানুষের প্রতিদিন যতটা লবণ বা চিনি খাওয়া উচিত, খাবার থেকেই অনেক সময় তার চেয়ে বেশি শরীরে প্রবেশ করে।ফলে যখন কোন মানুষ খাবার টেবিলে বা চায়ের সঙ্গে বা অন্য কোন ভাবে বাড়তি লবণ বা চিনি গ্রহণ করে, সেটা তার জন্য ঝুঁকির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।

দিনে এক চামচের বেশি লবণ নয়

মানুষের শরীরে যত সোডিয়াম ঢোকে, তার প্রধান উৎস লবণ।

যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) বলছেন, মানুষের দেহ ঠিকভাবে কাজ করার জন্য খুব কম পরিমাণ লবণ দরকার হয়। কিন্তু মানুষ প্রতিদিন সেই মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি লবণ গ্রহণ করছে।সংস্থাটি বলছে, একজন মানুষের বমিলিয়ে ২,৩০০ মিলিগ্রাম বা এক চা চামচের বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়।

পুষ্টিবিদ ফারজানা আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, মানুষের শরীরে সোডিয়াম ক্লোরাইডের বয়স অনুযায়ী চাহিদা আছে। কিন্তু কারও যদি লিভার, কিডনি বা বড় জটিলতা থাকে, তখন সেটার বেশি বা কম হলে সমস্যা তৈরি করতে পারে।

''আমরা সরাসরি লবণ খেতে একেবারেই মানা করে দেই। কিন্তু নানা খাবারের মধ্য দিয়ে একজনের শরীরে যতটুকু লবণ যাবে, তা যেন আধা চা চামচ থেকে এক চা চামচের বেশি না হয়,'' তিনি বলছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল বা সিডিসির তথ্য অনুযায়ী, অতিরিক্ত লবণ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের সম্ভাবনা অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে।বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাত খাবার অথবা রেস্তোরাঁয় খাবারে যে লবণ থাকে, সেটা নিয়ন্ত্রণের কোন উপায় থাকে না।

যেসব খাবারে লবণ বেশি থাকে

সিডিসির তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকানরা যত লবণ গ্রহণ করে থাকে, তার ৪০ শতাংশের বেশি আসে নীচের খাবারগুলো থেকে:

মাংসের স্যান্ডউইচ

পিৎজা

ট্যাকোস

সুপ

চিপস, ক্র্যাকার্স, পপকর্ন

ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বা চিকেন ফ্রাই

পাস্তা

বার্গার

ডিম ভাজা বা ডিমের নানা ভাজি আইটেম

কিন্তু এসব খাবারেও বিভিন্ন স্থানে লবণের মাত্রার কমবেশি হতে পারে। তবে লবণ ছাড়াও বেকিং সোডা, মনো-সোডিয়াম গ্লুটামেট, সোডিয়াম নাইট্রেটের মাধ্যমেও মানুষের দেহে সোডিয়াম প্রবেশ করে। সব মিলিয়ে সোডিয়ামের মাত্রা বেড়ে গেলেও স্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি হয়।তাই এফডিএ খাবার কেনা বা খাওয়ার পূর্বে সেটার গায়ে থাকা লেবেল দেখে নেওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছে।

তবে সবসময়ে যে লবণের মাত্রা দেখেই সোডিয়ামের উপস্থিতি বোঝা যায়, তা নয়। আচার বা সয়া সসের ভেতর সোডিয়ামের উপস্থিতি সহজে বোঝা যায়। কিন্তু সেরিয়াল এবং প্যাস্ট্রির ভেতরেও সোডিয়াম থাকে, যদিও সেটা হয়তো টের পাওয়া যায় না।

যে ১০ উপায়ে শরীর থেকে লবণের মাত্রা কমিয়ে আনা যায়

যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন বলছে, খাবারের ভেতরে থাকা লবণ সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং খাবার তৈরির নতুন উপায় বের করার মাধ্যমে শরীরের সোডিয়ামের মাত্রা ঠিক রাখা যেতে পারে। এজন্য তারা কিছু পরামর্শ দিয়েছে। এসব পরামর্শ অনুসরণ করে আস্তে আস্তে সোডিয়াম গ্রহণের হার কমিয়ে আনা হলে, তার সঙ্গে শরীরও সমন্বয় করে নেবে। ফলে স্বাদের তারতম্য হবে না।

এফডিএ যেসব পরামর্শ দিয়েছে:

১. খাবারের লেবেলে থাকা পুষ্টিমান পড়া

প্যাকেটজাত খাবার বা প্রক্রিয়াজাত খাবারের লেবেলে উপাদানের যে বর্ণনা থাকে, সেখান থেকে দিনে কতটুকু সোডিয়াম শরীরে প্রবেশ করছে, তা যাচাই করা যেতে পারে।

২. নিজের খাবার নিজে তৈরি করা

ইনস্ট্যান্ট নুডলস, তৈরি পাস্তা, নানা ধরনের সসের ব্যবহার কমিয়ে এনে নিজের খাবার তৈরি করা যেতে পারে।

৩. সোডিয়ামমুক্ত ফ্লেভার যোগ করা

রান্না করার সময় বা খাওয়ার সময় লবণ ব্যবহার করা যতটা সম্ভব কমিয়ে দিতে হবে। বিশেষ করে খাবার টেবিলে কাঁচা লবণ খাওয়া পরিহার করতে হবে। লবণের বদলে নানা ধরনের ভেষজ ব্যবহার করে স্বাদের পরিবর্তন আনা যেতে পারে।

৪. তাজা খাদ্যদ্রব্য

প্যাকেটজাত বা প্রক্রিয়াজাত খাবার না কিনে তাজা খাবার খাওয়ার প্রবণতা বাড়াতে হবে। তবে সেক্ষেত্রেও প্যাকেটে দেখে নেয়া ভালো যে, কোন লবণ পানি ব্যবহার করা হয়েছে কিনা।

৫. সস বা সিজনিং পরিহার

শাকসবজি বা সালাদ খাওয়ার সময় লবণ, সস ইত্যাদি ব্যবহার না করলে সোডিয়ামের মাত্রাও কমে আসবে।

৬. লবণাক্ত খাবার ধুয়ে খাওয়া

কৌটার বা প্রক্রিয়াজাত খাবার (যেমন সিমের বিচি, টুনা, সবজি) খাওয়ার পূর্বে ধুয়ে নেয়া যেতে পারে। তাহলে এসব খাবার থেকে সোডিয়ামের মাত্রা অনেক কমে আসবে।

৭. হালকা খাবারে লবণ পরিহার

সকাল বা বিকালের হালকা খাবারে লবণ বা সস জাতীয় পণ্য এড়িয়ে চলা ভালো। তার বদলে ফল বা গাজরের মতো খাদ্য খাওয়া যেতে পারে, যাতে সোডিয়াম থাকে না।

৮. বিকল্প ব্যবহার করুন

অনেক সময় সালাদের মতো পণ্যে সস বা ড্রেসিং ব্যবহার করার মাধ্যমে আসলে সোডিয়াম বা লবণ যোগ করা হয়। এফডিএ পরামর্শ দিচ্ছে, সস, বা বোতলের ড্রেসিং ব্যবহার না করে ভিনেগার, তেল সালাদে ব্যবহার করা যেতে পারে।

৯. খাবারের প্লেট হালকা করুন

কম খাবার মানেই কম সোডিয়াম। তাই ঘরে বা বাইরে খাওয়ার সময় ছোট টুকরো নেয়া, অল্প খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করা ভালো।

১০. জিজ্ঞেস করুন কম লবণের খাবার দিতে পারবে কিনা

রেস্তোরাঁ বা বাইরে কোথাও খাবার সময় জিজ্ঞেস করা যেতে পারে যে, তারা কম লবণের খাবার তৈরি করতে পারবে কিনা। এছাড়া সস বা সালাদের ড্রেসিং টেবিলে দেয়ার জন্য বলতে পারেন, তাহলে আপনি সেটা কম মাত্রায় ব্যবহার করতে পারবেন।

আরেক নীরব ঘাতক চিনি

চিনি, শর্করা বা সুগার, যে নামেই ডাকা হোক না কেন, গত কয়েক দশক ধরে এটি বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তারা বলছেন, এটি জনস্বাস্থ্যের অন্যতম প্রধান শত্রুতে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকার এর ওপর বাড়তি কর বসাচ্ছে। স্কুল আর হাসপাতালগুলো খাদ্যতালিকা থেকে একে বাদ দিয়ে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন: আমাদের খাবার থেকে চিনি সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দিতে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, উচ্চমাত্রার ফ্রুকটোজসমৃদ্ধ কর্ন সিরাপ বা বাড়তি চিনিওয়ালা পানীয়, জুস ড্রিংক, মধু, বা সাদা চিনি এগুলো হৃদযন্ত্রের সমস্যা তৈরি করতে পারে, কারণ তা ধমনির ভেতর ট্রাইগ্লিসারাইড জাতীয় চর্বি জমাতে ভূমিকা রাখে।বিভিন্ন জরিপে এই বাড়তি যোগ করা চিনি সমৃদ্ধ খাবার বা পানীয়ের সাথে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সম্পর্ক দেখা গেছে। এটি ক্যান্সারের ঝুঁকিও অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়।

চিনি বা অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার স্থূলতা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে। যেসব খাবার - যেমন বিভিন্ন ফলের রস বা মিশ্রণ এবং সিরাপ খাওয়ার ক্ষেত্রেও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।কিছু গবেষণায় বলা হয়, চিনি বা মিষ্টি খাওয়ার আকর্ষণ কোকেনের আকর্ষণের মতোই - যাকে বলা চলে একটা নেশা।

একাধিক গবেষণার ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোন এক দিনের খাবারে যদি ১৫০ গ্রামের বেশি ফ্রুকটোজ থাকে, তাহলে তা উচ্চ রক্তচাপ বা কোলেস্টেরলের মতো সমস্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

অনেক খাবারের মধ্যে চিনি যুক্ত থাকে, যাকে বলা হয় মুক্ত চিনি। যেমন মধু, সিরাপ, ফলের জুস ইত্যাদি। পেস্ট্রি, কেক, বিস্কুট, কোমল পানীয়ের মধ্যে যে চিনি যুক্ত থাকে, সেটিও এর অন্তর্ভুক্ত। এতে কেউ সরাসরি চিনি বা মিষ্টি না খেলেও এসব খাবার থেকে শরীরের চিনি প্রবেশ করে।আবার চা বা কফি, শরবতের সঙ্গে সরাসরি চিনি মিশিয়েও খাওয়া হয়। একে বলা হয় বাড়তি চিনি। উভয় ক্ষেত্রে শরীরের সরাসরি চিনি প্রবেশ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন বলছে, একজন ব্যক্তি প্রতিদিন যে পরিমাণ খাবার গ্রহণ করে, তার ১০ শতাংশের কম অতিরিক্ত চিনি বা বাড়তি চিনি খাওয়া উচিত।চকলেটের বাইরে চা এবং কফি এজন্য অনেকাংশে দায়ী।বিশ্বের অনেক দেশ চিনির ওপর বাড়তি কর বসিয়ে মিষ্টি খাওয়া কমানোর চেষ্টা করছে।

পুষ্টিবিদ ফারজানা আহমেদ বলছেন, সরাসরি কেউ চিনি না খেলেও তার শরীরের কোন সমস্যা হবে না। কারণ নানা খাবার থেকে শরীর চিনি বা গ্লুকোজ পেয়ে থাকে। তাই তার সরাসরি চিনি না খেলেও চলে। তাই আমরা সবাইকে পরামর্শ দেই, চিনি না খেয়ে পারলে ভালো। তারপরেও খেতে ইচ্ছা করলে এক চামচের বেশি নয়। আর শিশুর জন্মের দুই বছর চিনি ও লবণ দুইটাই মানা করি।অনেকের চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবারের প্রতি আসক্তি থাকে। বেশি সময় মিষ্টিজাতীয় খাবার না খেলে তাদের অস্থির লাগতে থাকে।

''এটা কাটাতে সচেতনভাবে আস্তে আস্তে চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া কমিয়ে আনতে হবে। আর আমরা টক দই খেতেও পরামর্শ দেই। কারণ টক দই খেলে মিষ্টির প্রতি জিহ্বায় একপ্রকার স্পর্শকাতরতা তৈরি হয়, তখন মিষ্টি খাওয়ার আগ্রহ কমে যায়,'' বলছেন পুষ্টিবিদ ফারজানা আহমেদ।

সূত্র : বিবিসি