জমি নিয়ে বিরোধ ও সহিংসতা : জীবনের ওপর কী প্রভাব ফেলে

জমি নিয়ে বিরোধ ও সহিংসতা : জীবনের ওপর কী প্রভাব ফেলে

জমি নিয়ে বিরোধ ও সহিংসতা : জীবনের ওপর কী প্রভাব ফেলে

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার খাসেরহাট গ্রামের বাসিন্দা তৌহিদুল ইসলাম। পূর্ব পুরুষের জমির বিরোধ নিয়ে তার বাবা এবং বড় ভাইকে হত্যা করা হয়েছে।

তৌহিদুল ইসলামের ভাষায়, তাদের জমি প্রতিপক্ষ দখল করে নিতে চাইলে ওই প্রতিপক্ষের সাথে দীর্ঘদিন বিরোধ চলছিল। এক পর্যায়ে তৌহিদুল ইসলামের ভাই এবং বাবা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।তিনি বলছেন, এখন তার পরিবারে সদস্য সংখ্যা ১১ জন। পরিবারের দু’জন কর্মক্ষম মানুষ নিহত হওয়ায় এখন সব দায়িত্ব তার উপর।

তিনি বলেন, ‘আমাদের অবস্থা একেবারে করুণ। আমরা যে কোথাও যাবো সে অবস্থা নেই। আমাদের এখন কোনো জমি নেই। দাদা আমাদের যে জমি দিয়ে গিয়েছিল সেই জমিতেই বসা আছি।’

‘আমরা একেবারে হাহাকার অবস্থায় আছি। কাউকে বলতে পারি না। আমি ক্ষেত-খামারে মজুর হিসেবে কাজ করি। আপনি হয়তো চোখে দেখলে বুঝতেন কেমন আছি আমরা।’ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৮ সালে। চলতি বছরের ফেব্রয়ারি মাসে আদালতের রায়ে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রতিপক্ষ পরিবারের পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছে আদালত। আর পরিবারের আরো বাকি তিনজনকে আজীবন কারাদণ্ড দিয়েছে।

এই পরিবারে কর্মক্ষম পুরুষরা সবাই এখন আসামি। পরিবারে রয়েছেন বৃদ্ধ মা এবং মেয়ে। মেয়েও আসামি ছিলেন। কিন্তু এখন জামিনে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তারা কথা বলতে রাজি হননি।অর্থাৎ এই এক ঘটনায় দুটি পরিবারের মানুষের জীবন এবং জীবিকার হয়ে পরেছে অনিশ্চিত।

অনিশ্চিত এক জীবন
বাংলাদেশের এমন অনেক পরিবার রয়েছে যারা জমির মালিকানার বিরোধ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন।রাজশাহীতে এক ব্যক্তি তার পূর্ব পুরুষের জমি নিয়ে বিরোধে জড়ান আজ থেকে পাঁচ বছর আগে।তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। এখন তিনি পলাতক। তার স্ত্রী বিবিসিকে বলেছেন, কীভাবে এ পরিবারটি বিপন্ন হয়ে গেছে।

এই নারী বলেন ‘আমার স্বামী পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে আজ প্রায় পাঁচ বছর। সংসারে কোনো খরচ দিতে পারেন না। মাঝে মাঝে ফোন করেন। আমার চারটা সন্তানের পড়াশোনা এখন বন্ধ। বাপের বাড়ি থেকে টাকা এনে সংসার চালাইছি প্রথম দিকে। কিন্তু কয়দিন টাকা চাওয়া যায়? আমি মানুষের বাড়ি কাজ করি।’

‘কিন্তু এটা কাউকে বলিনি। কারণ আমাদের যে পারিবারিক অবস্থা ছিল সেখানে আমার এই অবস্থা কারো বলতে পারি না। সন্তানদের নিয়ে কি করবো সেটাও জানি না। এখন অনিশ্চিত সব। সে ফিরবে কিনা, মামলা চলছে, কিছু বলতে পারছি না।’

মামলার মীমাংসা দ্রুত না হওয়া কী কারণ?
দেশে জমি সংক্রান্ত ১৪লাখ মামলা এখন অমীমাংসিত রয়েছে। আর এটা একটা বড় কারণ পরিবারগুলোর সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম ইন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, জমি সংক্রান্ত মামলাগুলো মীমাংসা হতে কয়েক প্রজন্ম চলে যায়। যার ফলে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক এবং শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

দেশে জমিসংক্রান্ত সহিংসতা ও মানুষের নিরাপত্তার ওপর তার প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের করা তিনটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে জমি নিয়ে বিরোধে সহিংসতা, প্রাণহানি, আহত মানুষের সংখ্যা ও মামলা বাড়ছে।

২০১৫ থেকে ২০২০- এই সময়কালের ঘটনা পর্যালোচনা করে তারা বলছে, দেশে প্রায় ৫০ লাখ পরিবার সরাসরি জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের মধ্যে রয়েছেন।

জমি নিয়ে বিরোধ ও সহিংসতা কীভাবে জীবন ও জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলে, সেই বিষয়টিও তাদের গবেষণায় এসেছে।সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, জমিসংক্রান্ত বিরোধ থেকে হামলা, খুন, মামলা, সম্পত্তি ধ্বংস, দখল, অপহরণ, জিম্মি করা ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে।

’একে তো জনগণের ঘনত্ব বেশি তার উপর নদীমাতৃক দেশ। ফলে নদী-ভাঙ্গন, চর ওঠা-নামা এই ধরণের পরিবর্তনগুলো মানুষের মধ্যে এক ধরণের বিরোধ তৈরি করে। জমির সঙ্গে অর্থের একটা বড় সম্পর্ক। আর জমিটা খুব সহজে পাওয়া যায়।’

‘অর্থাৎ বাবা বা দাদার সূত্রে জমির মালিক হয়। এখানে মান-সম্মান রক্ষার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় যে এগুলো আমার পূর্বপুরুষের জমি আমাকে এটা রাখতে হবে, না হলে ইজ্জত থাকবে না। কিন্তু এই করতে গিয়ে যে সর্বস্বান্ত হয়ে যায় সেটা খেয়াল থাকে না।’

জীবন ও জীবিকার ওপর প্রভাব
গবেষণা বলছে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে জমির বিরোধে আড়াই হাজারের বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটে।এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয় ২০২০ সালে, ৬৩৩টি।

আগের বছর সংখ্যাটি ছিল প্রায় পাঁচ শ’টি। এই ধরণের ঘটনায় পরিবারের পুরুষরা বেশি জড়িয়ে পরেন। ফলে কাজকর্ম থেকে অনেকটা সময় দূরে থাকতে হয় তাদের, মামলার চালানোর জন্য অর্থ খরচ করতে হয়। এতে জীবনের উপর প্রভাব পড়ে তেমনি জীবিকার উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে।ঢাকার একটি পরিবার তাদের জমি-জমা নিয়ে মামলা চালাতে গিয়ে এখন প্রায় দেউলিয়া।

পরিবারের একজন নারী সদস্য বলছেন, পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে ঢাকায় জীবন চালানো কঠিন। আবার গ্রামে ফিরে যাবেন সেই উপায়ও নেই।

এই নারী বলেন, ‘গ্রামে আমাদের কয়েক একর জমি ছিল, সেই জমির মধ্যে পুকুর ছিল, আমার চাচারা সেই জমি এবং পুকুর দখল করে নিয়েছে। আমরা ঢাকায় থাকি তেমন একটা খোঁজখবর রাখি না। আর ভাবতেও পারিনি যে আপনজনরা এমন দখল করবে।’

‘যখন টের পেলাম তখন আমার বাবা মামলা শুরু করলো চাচাদের বিরুদ্ধে। এখন এই মামলা চালাতে গিয়ে আমাদের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। এদিকে আমাদের গ্রামে যে সম্পত্তি রয়েছে সেগুলোর ব্যবস্থা করতে পারলে কিছুটা লাভ হত। কিন্তু সম্পর্কের এত অবনতি হয়েছে যে গ্রামে ফিরে যাওয়াটা এখন জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

জমি নিয়ে এই ভয়াবহ বিরোধের কারণ কী?
শুধুমাত্র জমির মালিকানার বিরোধ নিয়ে মানুষের জীবন এবং জীবিকার চিত্র যে সম্পূর্ণ পাল্টে দেয় তার বহু উদাহরণ সারা দেশজুড়ে রয়েছে।২০১৫ থেকে ২০২০ - এই কয় বছরে দেশে মোট ২০ হাজার ৪৬৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর প্রতি ১৭টি খুনের একটির নেপথ্যে ছিল জমিসংক্রান্ত বিরোধ।

এছাড়া একই সময়ে মোট ২৮ হাজার ৯৭১টি হামলার ঘটনা ঘটে।প্রতি ২০টি হামলার একটি হয় জমি নিয়ে বিরোধের জেরে।কিন্তু জমি নিয়ে এই ভয়াবহ বিরোধের কারণ কী? ভূমির বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করে অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম ইন বাংলাদেশ।

সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে জমি দখলে রাখার প্রবণতা বহু পুরনো।

‘ভূমির উপর অধিকার এবং ভূমির উপর তাদের যে নির্ভরশীলতা এইটাকে কেউ হারাতে চায় না। যারা কৃষিনির্ভর বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তারা ভূমিটাকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকে এবং তাদের জীবিকা নির্ভর করে। সেই কারণে আমাদের ভূমি ব্যবস্থাপনা যদি এফিসিয়েন্ট (দক্ষ) হওয়া দরকার ছিল যতটা ফেয়ার (নিরপেক্ষ) হওয়া দরকার ছিল সেখানে এত বছরে আমাদের দেশে সেটা গড়ে উঠেনি। এখানে প্রচুর অনিয়ম এখন আরো বেশি বেড়েছে।’

ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর সিরতা ইউনিয়নের নয়াপড়া গ্রামে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের হামলায় দুই ভাই নিহত হন।৪৫ বছর আগে জমি নিয়ে এমন বিরোধ থেকেই তাদের দু’জন পূর্বপুরুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। অর্থাৎ এই এক জমির বিরোধে দুই পুরুষ বা দুই প্রজন্মের চারজন প্রাণ হারিয়েছেন।

জমি সংক্রান্ত বিরোধে যারা জড়িয়েছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব ব্যক্তিরা যে শুধু আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সেটাই না, তাদের শারীরিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক সুস্থতাও হুমকির মধ্যে পরেছে। এর ফলে এসব মানুষ সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন জীবন কাটায় আর জীবিকায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

সূত্র : বিবিসি