৪২ ডিগ্রি ছাড়াল চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা, অতি তীব্র তাপপ্রবাহ

৪২ ডিগ্রি ছাড়াল চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা, অতি তীব্র তাপপ্রবাহ

৪২ ডিগ্রি ছাড়াল চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা, অতি তীব্র তাপপ্রবাহ

তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা চুয়াডাঙ্গা জেলাবাসীর। আজ বিকেল ৩টায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এ নিয়ে টানা ১৪ দিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হলো। মৃদু, মাঝারি ও তীব্র তাপপ্রবাহ শেষে এবার অতি তীব্র তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে এ জেলায়। তাপদাহে আমের গুটি, ধানের শীষ ঝরে যাচ্ছে। সবজি ক্ষেতসহ সকল প্রকার চাষ ব্যাহত হওয়ার আশংকা। হাসপাতালে শিশু রোগের সংখ্যা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক রকিবুল হাসান জানান, আজ টানা ১৪ দিনের মতো এ জেলায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আজ বিকেল ৩টায় ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, সহজে দেখা মিলছে না বৃষ্টির। এবারের গরমে ভিন্নমাত্রা রয়েছে। বাতাসের আদ্রতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম। তাই তাপদাহের মধ্যে ঠোট শুকিয়ে ও ফেটে যাচ্ছে। বাতাসের জ্বলীয়বাস্প কম থাকায় মূলত এমন হচ্ছে। সকালে সূর্য উঠার সাথে-সাথে তীব্র রোদ। বেলা বাড়ার সাথে-সাথে এ রোদ যেন আগুনের ফুলকি হয়ে ঝরছে। বিশেষ করে দুপুরের পর আগুনঝরা রোদেও তেজে বাইরে বের হওয়া মুশকিল হয়ে পড়ছে। গত ১৪ দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে এই চুয়াডাঙ্গায়।

এদিকে, টানা তাপদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড গরমের সাধারণ ও কর্মজীবী মানুষেরা অস্বস্তিতে পড়েছেন। তাপমাত্রাজনিত কারণে শিশু ও বৃদ্ধরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। প্রখর রোদের ঘাম ঝরানো তাপমাত্রার কারণে শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষজন চরম বিপাকে। বিশেষকরে তীব্র রোদের তাপের কারণে দিনমজুর, রিকশাচালক, ঠেলা ও ভ্যানচালকরা কাজ করতে পারছেন না। ফলে তীব্র তাপদাহে অনেকে অলস সময়ও পার করতে দেখা গেছে। আবার অনেকেই জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রচণ্ড তাপদাহ উপেক্ষা করে কাজে বেরিয়েছেন। এছাড়া এই তাপপ্রবাহে রোজাদারদের কষ্টও বেড়েছে। তীব্র গরমে বয়স্ক, শিশুরা পড়েছে সব থেকে বেশি ভোগান্তিতে।

রোজার মাস হওয়ায় একটু স্বস্তি পেতে ঠান্ডা শরবত, পানি, আইসক্রিম খেয়ে তৃষ্ণা মেটাতে পারছে না সাধারণ মানুষ। তিন-চার দিন আরো তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জীব-বৈচিত্র্যের ওপর। এমন প্রচণ্ড গরমে নাভিশ্বাস উঠেছে চুয়াডাঙ্গাবাসীর। এতে করে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। একটু শীতলতার জন্য শিশু-কিশোর সবাই পুকুর-নদী-বিলে ছোটাছুটি করছে। অসহনীয় প্রচণ্ড গরমে গ্রামাঞ্চল কিংবা শহরে শিশু, বয়স্কদের জ্বর-সর্দি- ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। তাপের কারণে নানা বয়সীদের দেখা দিয়েছে চর্ম রোগও। তীব্র তাপদাহে কয়েক দিন থেকে উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের বিভিন্ন হাট-বাজারে মানুষের সমাগম কিছুটা কমেছে। প্রচণ্ড গরমেই অনেকে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানও বন্ধ রেখেছেন।

জেলা শহরের ভ্যানচালক বাবুল মাসুম ও লিয়াকত জানান, গত এক সপ্তাহে প্রচণ্ড তাপদাহের কারণে ঠিকমতো কাজে যেতে পারছি না। গরমে কাজ করতে না পেরে আয় কমে গেছে। আগে দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করা যেত। এখন প্রচণ্ড গরমের কারণে সারা দিনে ২০০ টাকা আয় করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার শান্তিপাড়ার রুমি খাতুন বলেন, প্রচণ্ড গরম পড়েছে। বাচ্চা নিয়ে খুবই সমস্যায় আছি। ঘরের মধ্যে গরমে থাকা যায় না। আমার তিন সন্তান গত কয়েক দিন থেকে জ্বর-সর্দি ও কাশিতে ভুগছে। জানি না কবে বৃষ্টির দেখা মিলবে।

ভ্যান চালক শুকুর ও জোনাব আলী বলেন, কয়েক দিন থেকে ধরে যে তাপ উঠছে ভ্যান নিয়ে পাকা রাস্তায় বের হওয়া যাচ্ছে না। চাকা পানচার হয়ে যায় গরমে। এই গরমের মধ্যে ভাড়াও কমে গেছে। জানি না এ রকম প্রখর রোদ আর কত দিন থাকবে।

একটানা তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় হিট স্ট্রোক, হৃদ্রোগ, ডায়রিয়া, শিশুদের নিউমোনিয়াসহ গরমজনিত রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে প্রতিদিনই ৭০-৮০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছে। এর মধ্যে ডায়রিয়া ও টাইফয়েড রোগীই বেশি।তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় গরমের প্রভাবে সবচেয়ে সংকটে আছেন পরিবারের জ্যেষ্ঠ ও শিশু সদস্যরা। বাড়ি বাড়ি গরমজনিত জ্বর—ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। সদর হাসপাতাল ও জেলার তিনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গরমজনিত রোগের চিকিৎসা নিতে রোগীদের ভিড় বেড়েই চলেছে।

সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. ফাতেহ আকরাম জানান, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বেশির ভাগই গরমজনিত রোগে আক্রান্ত।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, তীব্র তাপদাহের কারণে বোরো ধান, আমের গুটি ঝরে শুকিয়ে যাচ্ছে। আমগাছে পানি স্প্রে এবং বোরো ধানসহ সব ধরনের সবজি ক্ষেতে প্রতিদিনই সেচ দিতে এবং সেচের পানি ধরে রাখার পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি কর্মকর্তারা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, প্রচণ্ড তাপদহের কারণে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক গরমে করণীয় বিষয়ে কৃষকদেরকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. মাহবুবুর বলেন মিলন, গরমে শিশুদের ডায়রিয়া, টাইফয়েড, শরীরে ঘাম বসে নিউমোনিয়া, ঠান্ডা, সর্দি, কাশি, জ্বর ও প্রস্রাবে সংক্রমণ দেখা দিচ্ছে। এসব রোগ নিয়েই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছে তারা। আমরা শিশুকে ঘরের বাইরে বের হতে দেওয়া যাবে না। টাটকা খাবার খাওয়াতে ও ফ্যানের নিচে রাখতে হবে।

এদিকে, দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় এই জেলাবাসীর নাজুক অবস্থা। অতিপ্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনের পরামর্শ। চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসন ও জেলা তথ্য অফিসের পক্ষ থেকে অতিপ্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সেই সাথে পর্যাপ্ত পানি পান করতে বলা হচ্ছে। লেবুর শরবত ও সেলাইন খাওয়ার ওপরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খান বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলার সব স্থানে মাইকিং করে জনসাধারণকে সতর্ক করা হচ্ছে। তারা যেন অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হয়। সন্ধ্যার পর শরবত, পানি ও ফলমূল বেশি বেশি খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। স্ট্রোক, ডায়রিয়াসহ গরমজনিত রোগীদের চিকিৎসায় বিশেষ ব্যবস্থা করার জন্য সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।