ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবার অংশগ্রহণ জরুরি

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবার অংশগ্রহণ জরুরি

ছবিঃ সংগৃহীত।

গত ১৭ জুলাই দেশে আটজনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছর এক দিনে এটাই সর্বাধিক মৃত্যু। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশে মৃত্যুর সংখ্যা হলো ১১৪। একই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এক হাজার ৫৮৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানিয়েছে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ২২ হাজার ৪৬৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।

চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে যত মানুষ আক্রান্ত ও যতজনের মৃত্যু হয়েছে, তা এর আগে কোনো বছরের প্রথম ছয় মাসে হয়নি। চলতি জুলাই মাসের প্রতিদিন ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের জুলাইয়ে ডেঙ্গুতে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

আর আক্রান্ত হয়েছিল এক হাজার ৫৭১ জন। এ বছরের প্রথম ১২ দিনেই মৃত্যু হলো ৪১ জনের।

দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী মারা যায় গত বছর, ২৮১ জন। এর আগে ২০১৯ সালে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়।

 

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবার অংশগ্রহণ জরুরিস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক-বর্ষা জরিপের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবার ডেঙ্গুর জীবাণুবাহক এডিস মশার ঘনত্ব এবং সম্ভাব্য প্রজননস্থলের সংখ্যা সর্বোচ্চ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৫টিই ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০১৯ সালে উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ড ছিল ২১টি। পূর্বাভাস রয়েছে, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।

এবার ডেঙ্গুর উপসর্গ এবং মশার আচরণও পাল্টে গেছে।

 

বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। অচেনা হয়ে গেছে ২৩ বছরের চেনা রোগটি। যারা দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবার আক্রান্ত হচ্ছে, তারা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের মধ্যে পড়ছে। এখনকার ডেঙ্গুর সঙ্গে ২০০০ সালের, এমনকি ২০১২ সালের ডেঙ্গুর আলামত, আচরণ ও সংক্রমণ শক্তির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য।

এখন আগের মতো জ্বরের পারদ তেমন ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে  না। বিরতি দিচ্ছে। শরীরে ব্যথা তেমন থাকছে না। প্লাটিলেট কমে গেলেও টের পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথমে মনে হবে সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশি, মাথা বা গলা ব্যথা। তবে চট করেই শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। কমে যাচ্ছে রক্তচাপ, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, রোগী অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে, যা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম নামে পরিচিত। এবার ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি হওয়ার অন্যতম কারণও শক সিনড্রোম।

আগে যেমন ধারণা ছিল এডিস মশা কেবল সকাল-সন্ধ্যা কামড়ালেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ হয়, এবার দেখা যাচ্ছে দিনের যেকোনো সময় কামড়ালেই ডেঙ্গু রোগ হচ্ছে।

কীটতত্ত্ববিদরাও বলছেন, মশা কম থাকা অবস্থায় মশা মারার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। সেটাই মোক্ষম উপায়। কিন্তু যখন মশা বেড়ে যায় বা মশার যন্ত্রণায় জনসাধারণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, তখন নেওয়া হয় মশা নিয়ন্ত্রণের কর্মসূচি বা ক্রাশ প্রগ্রাম। ভুল সময়ে ভুলভাবে নেওয়া এসব কর্মসূচিতে লাভ হয় সামান্যই। সম্প্রতি মেয়র আতিক যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সেটা স্বীকার করেই বলেছিলেন, ‘মশা নিধনে আমরা এত দিন ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। তাতে মশা ধ্বংস হয়নি, বরং অর্থের অপচয় হয়েছে।’

বারবার একই ওষুধ প্রয়োগের ফলে মশার দেহে সহনক্ষমতা বেড়ে যায়। প্রতিটি প্রাণীর দেহেই প্রকৃতিগতভাবে এই সহনক্ষমতা তৈরি হয়। ফলে উচ্চমাত্রার কীটনাশক ছিটানোর পরও সহনক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে এখন আর আগের মতো মশা মরছে না। তা ছাড়া একেক স্থানের মশার জন্য একেক ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু সিটি করপোরেশন সব জায়গায় একই ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকে। মশার উপদ্রব বাড়ার এটিও একটি কারণ।

কলকাতা সিটি করপোরেশন এডিস মশা দমনে সফলতা দেখিয়েছে। তাদের ১৪৪টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতেই সিটি করপোরেশনের ২০ থেকে ২৫ জন কর্মী থাকে। এর মধ্যে একদল প্রচারকাজ চালায়, অন্য দল কোথাও পানি জমছে কি না, তার ওপর নজর রাখে। থাকে একটি র‌্যাপিড অ্যাকশন টিম। তাতে সব ধরনের সরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুত থাকে আট থেকে ১০ জন। গাড়িও থাকে তাদের কাছে। কোনো জায়গায় ডেঙ্গুর খবর পাওয়া গেলে অতিদ্রুত সেখানে পৌঁছে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং এডিস মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণে কাজ করা হয়।

বিশ্বজুড়েই ডেঙ্গুর প্রকোপ রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকা ও এশিয়া অঞ্চলে সর্বোচ্চ প্রকোপ লক্ষ করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেশি পরিলক্ষিত হয়। প্রতিবছর পাঁচ থেকে ৫০ কোটি মানুষ বিশ্বের ১১১টি দেশে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ১০ থেকে ২০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী গত ৩০ বছরে বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে ৩০ গুণ। এ ছাড়া জিকা, চিকুনগুনিয়া ও ইবোলা ফিভারের প্রাদুর্ভাবও বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরো বলেছে, মশা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী প্রাণী। জীবাণু বহন ও তা মানুষে ছড়িয়ে দেওয়ার সক্ষমতা থাকায় মশার কারণে বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর লাখো মানুষের মৃত্যু হয়।

আবহমান কাল থেকেই বাংলাদেশে বৃষ্টি মৌসুমে জ্বর, কাশি, সর্দি, মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা নিয়ে কথিত ঠাণ্ডা রোগে আক্রান্ত হয় লাখ লাখ মানুষ। চিকিৎসকরা এসব ক্ষেত্রে সাধারণত প্যারাসিটামল ওষুধ সেবন, বেশি বেশি পানি পান এবং পর্যাপ্ত বিশ্রামের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বেশির ভাগ রোগী তাতেই ভালো হয়ে যায়। এ নিয়ে পরে আর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় না।

দেশের ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সচেতন হয়েছে এবং চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধাও বেড়েছে। এর আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে খুব একটা এই রোগ শনাক্ত করা হয়নি। কিন্তু এডিস মশাও ছিল, রোগও ছিল।

উপসর্গ ও প্লাটিলেট সংখ্যা দিয়ে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা যায় না। এনএস-১ অ্যান্টিজেন এবং ডেঙ্গু ভাইরাস অ্যান্টিবডি ছাড়া ডেঙ্গু রোগ শনাক্ত করা সম্ভব নয়। এ মৌসুমে অনেক ভাইরাসের কারণে মানুষ একই ধরনের উপসর্গে ভোগে এবং প্লাটিলেটের সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে যায়।

খুব পরিষ্কারভাবে মনে রাখতে হবে সব জ্বরই ডেঙ্গু নয় এবং প্লাটিলেট সংখ্যা কমে যাওয়া ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ নয়। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ আছে। প্রথমবার আক্রান্ত হলে সাধারণত কোনো বড় ধরনের উপসর্গ হয় না। দ্বিতীয়বার অন্য সেরোটাইপ দ্বারা আক্রান্ত হলে বড় ধরনের উপসর্গ হতে পারে।

আক্রান্ত রোগীদের ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের (Severe) উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এখন অন্যান্য উপসর্গের পাশাপাশি নাক, চোখ, মুখ, মলের সঙ্গে রক্তক্ষরণ হতে পারে। দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে জ্বরের মাত্রা কম হতে পারে। ডেঙ্গু রোগের সাধারণ চিকিৎসা প্যারাসিটামল, শরীরে পানিস্বল্পতা দ্রুত পূরণ এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম। ঝবাবত্ব পর্যায়ে চিকিৎসাও খুব জটিল নয়, কিন্তু বিশেষ করে  Plasma leakage -এর অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

দায়িত্বটা চিকিৎসকদের। তাঁদের ওপর নির্ভর করতে হবে। চিকিৎসার জন্য এমবিবিএস ডাক্তারই যথেষ্ট, জটিল হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

সঠিক কর্মপদ্ধতির জন্য সঠিক পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করতে হবে। ধারণা থেকে বা উপসর্গ দেখে ডেঙ্গু বলা যাবে না। গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষকে পরীক্ষানির্ভর সঠিক চিত্রটি জানতে হবে, তাহলে আতঙ্ক বা হতাশা অনেক কমে যাবে।

বর্তমান সময়ে জরুরি করণীয় :

১. হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার রি-এজেন্ট সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

২. অতিদ্রুত সঠিক ওষুধ ক্রয় করে পরিকল্পিতভাবে ব্যাপক মশক নিধন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে।

৩. জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত করতে হবে।

৪. স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন/পৌরসভা, জনপ্রতিনিধি, সামাজিক শক্তি ও জনগণকে নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

৫. অবশ্যই ঘর ও বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব পরিবারকেই নিতে হবে।

৬. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব শিক্ষক-ছাত্র-কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে।

৭. মশক নিধন হতে হবে কীটতত্ত্ববিদদের নেতৃতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে।

৮. Communicable Disease Control (CDC)  বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে।

৯. চিকিৎসক ও কীটতত্ত্ববিদদের মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগ এবং মশা বিষয়ে গবেষণার দ্রুত সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

যেকোনো রোগেই মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। এ দেশে নানা মহামারি হয়েছে। ঝড়, প্লাবন, বন্যায় অসংখ্য মানুষের জীবন গেছে। আমরা সম্মিলিতভাবে যার যার দায়িত্ব পালন করে সেসব প্রতিহত করেছি। ডেঙ্গু রোগে কী করণীয় তা আমরা সবাই জানি। আতঙ্কিত না হয়ে আমরা সবাই মিলে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণ করা অবশ্যই সম্ভব।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়