মণিপুর সঙ্কটে যেভাবে ২ পক্ষের রোষের শিকার পাঙ্গাল মুসলিমরা

মণিপুর সঙ্কটে যেভাবে ২ পক্ষের রোষের শিকার পাঙ্গাল মুসলিমরা

মণিপুর সঙ্কটে যেভাবে ২ পক্ষের রোষের শিকার পাঙ্গাল মুসলিমরা

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে গত কয়েক মাস ধরে চলা রক্তাক্ত জাতিসঙ্ঘাতের মাঝখানে পড়ে সেখানে বসবাসবাসকারী তিন লাখেরও বেশি ‘পাঙ্গাল’ মুসলিম দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পড়েছেন।

মণিপুরের পাঙ্গাল সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয়রা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, রাজ্যের বিবদমান দুটি গোষ্ঠী-মেইতেই এবং কুকি-জোমি উভয়েই এখন তাদের অবিশ্বাস করতে শুরু করেছেন এবং তারা দু’তরফ থেকেই হামলার আশঙ্কায় ভুগছেন।পাঙ্গালদের একটি সংযুক্ত কমিটি গত সপ্তাহান্তে দেশের রাজধানী দিল্লিতে এসে মণিপুরে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জরুরি হস্তক্ষেপও দাবি করেছেন-যাতে তারা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন।

ওই কমিটির মুখপাত্র মহম্মদ রইস আহমেদ টাম্পাক ওই দিন বলেন, ‘মণিপুর এখন পুরোপুরি যুদ্ধক্ষেত্রর চেহারা নিয়েছে। আর পাঙ্গাল মুসলিমরা রাজ্যের যেখানে থাকেন সেটাকে বলা যেত পারে ওই যুদ্ধের বাফার জোন-কারণ আমাদের বসবাস মেইতেই আর কুকি-জোমি অধ্যুষিত এলাকার ঠিক সীমান্তে। এখন এই সঙ্ঘাতে আমরা কারো পক্ষ না নিয়ে শান্তি ফেরানোর কথা বলছি কিন্তু এখন পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে আমরা এক রকম ‘মাইনকার চিপা’য় পড়ে গেছি বলেই মনে হচ্ছে। ‘মাইনকার চিপা’ হলো এমন একটি বাংলা শব্দবন্ধ-যখন কেউ কোনো সঙ্কটের মাঝখানে পড়ে যায় এবং সেখান থেকে পরিত্রাণের রাস্তাও তার হাতে থাকে না-ওই পরিস্থিতিকে বোঝাতেই তা ব্যবহৃত হয়। আহমেদ অল্প অল্প বাংলা জানেন বলে এই শব্দটির সাথে পরিচিত।

মণিপুরের মেইতেই-প্রধান বিষ্ণুপুর ও কুকি-প্রধান চূড়াচাঁদপুর জেলার সীমান্তে যে কোয়াকটা শহর, সেখানেই পাঙ্গালরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন।এই কোয়াকটাতে ৯০ শতাংশেরও বেশি বাসিন্দা মুসলিম ধর্মাবলম্বী, যাদের সাথে চলমান সঙ্ঘাতের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ তাদেরও এখন হামলার ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় পালিয়ে যেতে হচ্ছে বলে পাঙ্গাল নেতারা জানাচ্ছেন।

শান্তির আর্জি নিয়ে দিল্লিতে
বুধবার (৩ মে) মণিপুরে ভয়াবহ জাতিযুদ্ধ শুরু হওয়ার দিনকয়েক পরেই রাজ্যের পাঙ্গাল মুসলিমরা ‘ইউনাইটেড মেইতেই পাঙ্গাল কমিটি’ (ইউএমপিসি) মণিপুর নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের কাছাকাছি এই পাঙ্গাল মুসলিমরা।

মণিপুরের মুসলিম বা ‘পাঙ্গাল’রা নিজেদের মেইতেই বলেই গণ্য করেন। যদিও অতীতে হিন্দু প্রধান মেইতেই ও পাঙ্গালদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার ঘটনাও ঘটেছে। ১৯৯৩ সালে রাজ্যের থৌবাল জেলায় এমনই এক সাম্প্রদায়িক হামলায় শতাধিক পাঙ্গাল মুসলিমের প্রাণহানি হয়েছিল।এবারের মেইতেই-কুকি সংঘর্ষে পাঙ্গালরা যাতে কোনোভাবে জড়িয়ে না পড়েন সম্প্রদায়ের নেতারা সে ব্যাপারে প্রথম থেকেই খুব সতর্ক ছিলেন।

ইউএমপিসি নেতারা বলছেন, সঙ্ঘাতদীর্ণ রাজ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা আগাগোড়া কাজ করে আসছেন। কুকি বা মেইতেই কারো পক্ষ নিয়েই তারা কোনো বিবৃতি দেননি-শুধু শান্তি ফেরানোর কথা বলেছেন।

কিন্তু সঙ্ঘাত শুরু হওয়ার পর প্রায় মাসচারেক পরে এসে এখন দেখা যাচ্ছে তাতেও কিন্তু পাঙ্গালরা শেষরক্ষা করতে পারেননি। রোবাবার (৬ আগস্ট) পাঙ্গাল-অধ্যুষিত কোয়াকটা শহরে তিনজন হিন্দু মেইতেই নিহত হন। ওই ঘটনার পর মেইতেইরা সন্দেহ করেন, স্থানীয় পাঙ্গাল মুসলিমরাই বোধহয় এই হত্যাকাণ্ডে লাগোয়া এলাকার কুকি-জোমিদের সাহায্য করেছেন।

এদিকে কোয়াকটা শহরের খুব কাছেই লেইথান নামে একটি গ্রামও পুরোপুরি খালি করে দিয়ে সেখানে বসবাসকারী পাঙ্গালরা অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই খালি গ্রামের দখল নিয়ে সশস্ত্র মেইতেই গোষ্ঠীগুলো সেখানে তাদের ঘাঁটি গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে চূড়াচাঁদপুরে কুকিদের ওপর হামলা চালানো হতে থাকে। এরপর প্রধানত খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ভুক্ত কুকি-জোমিরাও মনে করতে শুরু করেছেন, পাঙ্গাল মুসলিমরা নিশ্চয় মেইতেইদের সাথে হাত মিলিয়ে তাদের ওপর হামলার পরিকল্পনা আঁটছেন।ইউএমসিপি মণিপুরের আহ্বায়ক মওলানা মুহিয়েদ্দিন সে কারণেই বলছিলেন, ‘গোটা রাজ্য জুড়ে যে জাতিভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির রমরমা শুরু হয়েছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা পাঙ্গালরাও তার শিকার হচ্ছি।’

বস্তুত বিভিন্ন জাতি-ধর্মের লোকজনের বসবাসের কারণে যে মণিপুরকে একদিন ‘মিনি ইন্ডিয়া’ বলে লোকে চিনত, ধর্মীয় বিভাজনের কারণে তা আজ টুকরো টুকরো হওয়ার পথে, এমনও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন তিনি।এই উদ্বেগের কথা দিল্লিতে সরকারের কানে পৌঁছে দিতেই মণিপুরের পাঙ্গাল নেতারা গত সপ্তাহে দেশের রাজধানীতে এসেছিলেন।

মণিপুরে শান্তি ফেরানোর আর্জি জানিয়ে তারা স্মারকপত্র তুলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-র কার্যালয়ে। রাজ্যে তারা দেশের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ও জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের হস্তক্ষেপও দাবি করেছেন।শুক্রবার (১৮ অগাস্ট) ইউএমসিপি নেতারা দিল্লির ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবেও একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন। বস্তুত এরপর থেকেই মণিপুর সঙ্কটে সেখানকার মুসলিমদের দুর্দশার দিকে জাতীয় পর্যায়ে মূল ধারার মিডিয়ার নজর পড়তে শুরু করেছে।

মণিপুরে পাঙ্গালদের ইতিহাস
ভারতের মণিপুরে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা যে বেশ কয়েক শ’ বছর ধরে বসবাস করছেন, ইতিহাসই তার সাক্ষ্য দেয়।

মণিপুরে প্রথম বড় আকারে মুসলিম বসতির সূত্রপাত সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ায়, যখন আজকের বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল থেকে এক বিরাট মুসলিম সৈন্যবাহিনী মণিপুরের তখনকার রাজা খাগেম্বার (১৫৯৭-১৬৫২) রাজত্বে হামলা চালিয়েছিল। তখন অবশ্য ওই রাজত্বের নাম ছিল কাংলেইপাক।

রাজা খাগেম্বা যুদ্ধে জিতলেও পরাজিত মুসলিম সেনাদের তার রাজত্বে বসতি স্থাপন করার অনুমতি দিয়েছিলেন। আর সেই সুবাদেই মণিপুরে ইসলামের প্রবেশ। পরে মণিপুরের মুসলিমরা ধীরে ধীরে ওই এলাকার মূল ধারার জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে গিয়েছেন, রাজার সেনাবাহিনী ও প্রশাসনেও তারা অনেকেই চাকরি করতেন।

বস্তুত ১৮০০ সালে বার্মা(বর্তমানে মিয়ানমার) কিংবা ১৯০০ সালকে ব্রিটিশ বাহিনী মণিপুরে যে অভিযান চালিয়েছিল, তা রুখে দিতে রাজ্যের মুসলিম সৈন্যরা বড় ভূমিকা রেখেছিলেন বলে গবেষকরা জানাচ্ছেন।
তবে মণিপুরে এই ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা কিভাবে ‘পাঙ্গাল’ নামে পরিচিত হলেন তার উৎস নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে দ্বিমত আছে।কেউ কেউ বলেন, পাঙ্গাল শব্দটি এসেছে ‘মাঙ্গাল’ থেকে-যেটি বাদশাহী ‘মুঘল’ শব্দের একটি স্থানীয় অপভ্রংশ।

আবার কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, পাঙ্গাল কথাটি এসেছে ‘বঙ্গাল’ বা বাংলা থেকে-কারণ এক সময় ওই অঞ্চল থেকে এসেই বেশিরভাগ মুসলিম মণিপুরে এসেছিলেন। নামকরণের উৎস যাই হোক, পাঙ্গালরা আজ যে মণিপুরের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই।পর্যবেক্ষকরা বলেন, ৬০ আসনের মণিপুর বিধানসভায় কমপক্ষে ১৮টি আসনের ফলাফল প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন পাঙ্গালরা।

রইস আহমেদ টাম্পাক বলেছিলেন, ‘রাজ্যে এই মুহুর্তে কমপক্ষে তিনজন পাঙ্গাল মুসলিম এমএলএ আছেন, সরকারি প্রশাসন বা পুলিশেও পাঙ্গালদের সংখ্যা কম নয়। তবে তাই বলে জনসংখ্যার মাত্র আট থেকে নয় শতাংশ লোক হয়ে আমরা নিশ্চয় ৫০ শতাংশ হিন্দু বা ৪০ শতাংশ খ্রিষ্টান ভাইদের সাথে লড়াই করতে যাব না। বরং আমরা সেই শুরু থেকে কোয়াকটাতে ত্রাণ শিবির চালাচ্ছি, দুর্গতদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করছি। আমরা কারো পক্ষে নই-শুধুমাত্র শান্তির পক্ষে। আর এই জিনিসটা কুকি আর মেইতেইরা বুঝলেই পাঙ্গালরা একটু শান্তি পাবে।’

সূত্র : বিবিসি