মুসলিম প্রধান দেশ হয়েও ইসরায়েলের পাশে কেন জর্ডান?

মুসলিম প্রধান দেশ হয়েও ইসরায়েলের পাশে কেন জর্ডান?

ছবি: সংগৃহীত

ইরানের সাথে ইসরায়েলের সংঘাত ঘিরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আরব দেশ জর্ডানের ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি বেশ কৌতূহল তৈরি হয়েছে। ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা করার জন্য আমেরিকা ও ব্রিটেনের পাশাপাশি বেশ কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে জর্ডান।

যদিও এক বিবৃতিতে জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বলেছেন, তারা নিজের দেশকে রক্ষার অংশ হিসেবে ইরানের ড্রোন ভূপাতিত করেছে; ইসরায়েলকে সাহায্য করার জন্য নয়।

জর্ডানের এই বিবৃতিকে ‌‘‘ভারসাম্য রক্ষার’’ কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে। কোনও কোনও পর্যবেক্ষক বলেছেন, হামাস, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যে সংঘাত চলছে সেখানে ‘ক্রসফায়ারে’ পড়তে চায় না জর্ডান।

এ কথা ঠিক যে জর্ডানের রাজতন্ত্রের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। গত ২৫ বছর যাবৎ জর্ডানের বাদশাহ রয়েছেন দ্বিতীয় আবদুল্লাহ। পর্দার আড়ালে জর্ডানের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্কও একেবারে খারাপ নয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষক এমিলি হোকায়েম লিখেছেন, ‘‘জর্ডান প্রমাণ করতে চেয়েছে, তারা আমেরিকা এবং ইসরায়েলের ভালো সহযোগী। কিন্তু এ বিষয়টি নেতানিয়াহুর কাছে থেকে আশা করবেন না। গাজায় হামলা বন্ধ এবং পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমে উসকানি বন্ধ করার জন্য আম্মানের আহ্বানে সাড়া দেবে না।’’

তবে ভিন্ন যুক্তিও আছে। ভৌগোলিকভাবে জর্ডানের অবস্থান এমন একটি অবস্থায় রয়েছে যে ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে কোনও যুদ্ধ শুরু হলে সেটির সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে জর্ডানের ওপর।

জর্ডানের নাগরিক ও যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক আটলান্টিক কাউন্সিলের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক ডেপুটি ডিরেক্টর মাসুদ মোস্তাজাবি বলেন, ‘‘ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে এই উত্তেজনা যদি পুরোপুরি যুদ্ধে রূপ নেয়, তাহলে এখন যাদের ইসরায়েলের রক্ষাকর্তা বলে মনে করা হচ্ছে তারাও একসময় আক্রান্ত হবে এবং সেই যুদ্ধে তাদেরও টেনে আনা হবে।’’

তিনি লিখেছেন, জর্ডানে বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনি শরণার্থী, ভঙ্গুর অর্থনীতি এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান— এসব কিছুই তাদের চিন্তার কারণ।

• জর্ডান-ইসরায়েল স্বার্থ
১৯৯৪ সালে জর্ডান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি হয়, যার মাধ্যমে জর্ডান ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭৯ সালে মিসর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর জর্ডান ছিল স্বীকৃতি দানকারী দ্বিতীয় আরব মুসলিম দেশ।

ইসরায়েলের সংবাদপত্র টাইমস অব ইসরায়েলে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের মার্চ মাসে জর্ডান এবং ইসরায়েলের মধ্যে পানি চুক্তি নবায়ন করার জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানায় জর্ডান। কিন্তু এর বিপরীতে জর্ডানকে পাল্টা শর্ত দিয়েছে ইসরায়েল।

এই শর্ত হচ্ছে— গাজা ইস্যুতে জর্ডান যাতে খুব বেশি শক্ত অবস্থান না নিয়ে তাদের অবস্থান নরম করে। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে আরেকটি চুক্তির আওতায় জর্ডান ইসরায়েলের কাছে সৌর বিদ্যুৎ রপ্তানি করছে।

পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বলছেন, জর্ডান প্রকৃতপক্ষে একটি ‌‘‘চিকন সুতার’’ ওপর দিয়ে হাঁটছে। একদিকে, আমেরিকা এবং ইসরায়েলের সাথে তাদের কৌশলগত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা। কারণ আর্থিকভাবে দুর্বল দেশ জর্ডান নানা ধরনের সহায়তার জন্য আমেরিকা এবং ইসরায়েলের ওপর নির্ভরশীল।

অন্যদিকে, ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা। কারণ, জর্ডানের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক ফিলিস্তিনি শরণার্থী। দ্য ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির জ্যেষ্ঠ ফেলো ঘাইথ আল-ওমারি দ্য টাইমস অব ইসরায়েলকে বলেছেন , বেশ কয়েক বছর ধরে ইরান জর্ডানের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। যেমনটা ইরান করেছে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন এবং ইয়েমেনের ক্ষেত্রে। এসব দেশে ইরানের এক ধরনের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব তৈরি হয়েছে। ফলে এসব দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়ে গেছে। ইরান চেষ্টা করছে জর্ডানেও তাদের সে প্রভাব তৈরি করতে।

‘‘ইসরায়েল যদি জর্ডানের আকাশসীমা ব্যবহার করে ইরানে আক্রমণ করে তাহলে সেটিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ইরান জর্ডানেও হামলা করতে পারে। এ বিষয়টি নিয়ে জর্ডান চিন্তিত,’’ লিখেছেন আল-ওমারি।

তিনি বলেন, জর্ডান এবং ইসরায়েলের মধ্যে নানা ধরনের রাজনৈতিক উত্তেজনা সত্ত্বেও সামরিক এবং গোয়েন্দা সহযোগিতা তখনও থেমে থাকেনি। ইসরায়েল এবং জর্ডান উভয় দেশ সামরিক ক্ষেত্রে পরস্পরের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে।

১৯৯৪ সালে জর্ডান ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি চুক্তির পর থেকে দুই দেশের মধ্যে শক্ত নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সহযোগিতা তৈরি হয়েছে। মুসলিমদের পবিত্র এলাকা আল-আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডের মুতওয়াল্লি বা কাস্টোডিয়ান হচ্ছে জর্ডান।

শান্তি চুক্তি অনুযায়ী, মাল্টি বিলিয়ন ডলার প্রোজেক্টের মাধ্যমে জর্ডানে গ্যাস ও পানি সরবরাহ করে ইসরায়েল। পৃথিবীর যেসব দেশে পানির তীব্র সংকট রয়েছে তার মধ্যে জর্ডান অন্যতম। জর্ডান চারপাশ থেকে স্থলসীমা বেষ্টিত।

• ইসরায়েল খুশি
ইরানের প্রতিশোধমূলক আক্রমণ থেকে জর্ডান যেভাবে ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা করেছে তাতে বেশ খুশি হয়েছে ইসরায়েলিরা। ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম বিশ্লেষণ করলে সে চিত্র দেখা যায়।

টাইমস অব ইসরায়েলের অপর এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ইরানের হামলা রুখতে জর্ডান যেভাবে সহায়তা করেছে তাতে অনেক ইসরায়েলিও বিস্মিত হয়েছেন। কারণ, গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধের কড়া সমালোচক জর্ডান। তারা ইসরায়েলের সাথে কূটনীতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য জর্ডানের সরকার দেশের ভেতরে জনগণের দিক থেকে বেশ চাপের মুখে আছে।

তবে ইসরায়েলের প্রতি জর্ডানের সামরিক সাহায্যের বিষয়টি একেবারে আকস্মিক কিছু নয় বলেও মনে করেন অনেকে।

দ্য ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির ফেলো ঘাইথ আল-ওমারি দ্য টাইমস অব ইসরায়েলকে বলেছেন, জর্ডান যেভাবে ইসরায়েলকে সহায়তা করেছে সেটির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে শক্ত নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে।

• ইতিহাস কী বলে?
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত মোট চারটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে জর্ডান। ১৯৯৪ সালে জর্ডান এবং ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের সংস্থা ‘ইউএন রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রেফিউজিস ইন দ্য নিয়ার ইস্টের হিসেবে, প্রায় ২২ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী জর্ডানে নিবন্ধিত আছেন। কিন্তু নিবন্ধনের বাইরেও আরও অনেক ফিলিস্তিনি শরণার্থী জর্ডানে অবস্থান করছেন। সব মিলিয়ে এই সংখ্যা ৩০ লাখ কিংবা তার চেয়ে বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

১৯৫১ সালে জর্ডানের তৎকালীন বাদশাহ আবদুল্লাহ জেরুসালেমে আল-আকসা মসজিদে প্রবেশের সময় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একজন ফিলিস্তিনি আরব এই হত্যাকারী ছিলেন। বাদশাহ আবদুল্লাহকে ফিলিস্তিনিদের অনেকেই পছন্দ করতেন না। এর একটি বড় কারণ ছিল প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে ফিলিস্তিন নিয়ে তার ভূমিকা।

শুধু তাই নয়, ১৯৭১ সালে জর্ডানের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করেছিল ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীরা। যদিও প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে কয়েকটি প্রতিবেশী আরব দেশের সাথে মিলে জর্ডানও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। জর্ডান যুদ্ধে অংশ নিলেও ভেতরে ভেতরে বাদশাহ আবদুল্লাহ ইসরায়েলের সাথে আঁতাত করেছেন।

প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ১৯৫০ সালে জর্ডান তাদের সীমান্তের সাথে ফিলিস্তিনি কিছু ভূখণ্ডকে জর্ডানের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। বাদশাহ আবদুল্লাহর এই পদক্ষেপে পশ্চিমা দেশগুলো সমর্থন দিলেও ফিলিস্তিনিরা সেটি মানতে পারেননি।

বাদশাহ আবদুল্লাহকে হত্যা করার পর মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর গোপন প্রতিবেদনে তাকে ব্রিটেন-পন্থী হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তখন সিআইএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাদশাহ আবদুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্টবিরোধী এবং পশ্চিমা-পন্থী একজন শাসকের অবসান হলো।

তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়ে জর্ডানের কোনও আগ্রহ ছিল না। তখন জর্ডানের বাদশা ছিলেন হুসেইন। তার নীতি ছিল আরব জাতীয়তাবাদ এবং ইসরায়েলের সাথে সহাবস্থান। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল সংকট নিয়ে জর্ডান ইসরায়েলের বিরুদ্ধাচরণ করলেও পরবর্তীতে ইসরায়েলের ব্যাপারে তিনি অনেকটা বাস্তববাদী অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালে জর্ডানের বাদশা হুসেইন গোপনে আলোচনা শুরু করেন ইসরায়েলি নেতাদের সাথে।

ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ-ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ আভি শ্লেইম ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন দ্য মিডল ইস্ট বইয়ে লিখেছেন, ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল যখন জর্ডানে হামলা চালায় তখন জর্ডানও এই যুদ্ধে জড়িয়ে যায়।

ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য আলাদা দু’টি রাষ্ট্র গঠনের যে প্রস্তাব জাতিসংঘে উত্থাপিত হয়েছিল সেটিকে একমাত্র আরব দেশ হিসেবে সমর্থন দিয়েছিল জর্ডান। সেটির বিনিময়ে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ অন্যান্য আরব ভূমি তাদের আওতায় আনতে চেয়েছিলেন।

সেন্টার ফর ইসরায়েল এডুকেশন বলছে, ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার কিছুদিন আগে তৎকালীন প্রভাবশালী ইহুদি নেতা গোল্ডা মেইর আম্মানে গিয়ে গোপনে বৈঠক করেছিলেন জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহর সাথে। প্রথম আরব ইসরায়েল যুদ্ধের পর জর্ডান আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুসালেম দখল করে নেয়। সেখানে বসবাসরত ফিলিস্তিনি অধিবাসীদের জর্ডানের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।

সেন্টার ফর ইসরায়েল এডুকেশনের ওয়েব সাইটে বলা হয়েছে, এর আগে ইসরায়েল এবং জর্ডানের মধ্যে বেশ কিছু গোপন বৈঠক হয় যুদ্ধবিরতি নিয়ে। আরব লীগের অন্যান্য দেশ জর্ডানের এসব কর্মকাণ্ড তখন মেনে নিতে পারেনি।

১৯৬৭ সালে তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের আগ পর্যন্ত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সে যুদ্ধের পর এসব অঞ্চল ইসরায়েল দখল করে নেয়।

এরপর ২০ বছর ধরে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম ফেরত পাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল জর্ডান। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৮ সালে জর্ডান পশ্চিম তীর থেকে তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে এবং বিষয়টি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের ওপর ছেড়ে দেয়। কিন্তু তারা পূর্ব জেরুজালেমের ওপর তাদের প্রভাব বজায় রাখতে চেয়েছিল। তবে তাতে তারা সফল হয়নি। বিবিসি বাংলা।