উদ্দেশ্যমূলক মূল্যবৃদ্ধি করে মুনাফা

উদ্দেশ্যমূলক মূল্যবৃদ্ধি করে মুনাফা

উদ্দেশ্যমূলক মূল্যবৃদ্ধি করে মুনাফা

সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ সমাজবদ্ধভাবে একত্রে মিলেমিশে বসবাস করে। প্রয়োজনের তাগিদে একে অন্যের সাথে পারস্পরিক লেনদেন এবং জিনিসপত্রের আদান-প্রদান করে থাকে। প্রাত্যহিক লেনদেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ব্যবসায়-বাণিজ্য। ব্যবহারিক জীবনে ব্যবসায়-বাণিজ্যে পণ্য ও মূল্যের বিনিময় হয়ে থাকে। ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে পণ্য ও মূল্যে যৌক্তিক বিনিময় আদান-প্রদান হওয়া কাম্য হওয়া সত্ত্বেও যখন বিক্রেতা অতি মুনাফার লোভে চড়ামূল্যে বিক্রয় করার জন্য পণ্যসামগ্রী কুক্ষিগত করে, তখন একে বলে মজুদদারি।

এর ফলে পণ্যের মূল্য বেড়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায় এবং জনজীবন বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে। মজুদদারির কারণে কোনোভাবেই যেন জনজীবন বিপর্যস্ত না হয়ে পড়ে, সেজন্য কুরআন ও হাদিসে এর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ব্যবসায়-বাণিজ্য। ইসলাম ব্যবসায়-বাণিজ্য উৎসাহিত করতে যেমন বিভিন্ন রকম জাগতিক ও পারলৌকিক প্রাপ্তির ঘোষণা দিয়েছে তদ্রুপ বিভিন্ন ধরনের নৈরাজ্যকর ও অবাঞ্ছনীয় পদক্ষেপ প্রতিরোধে জাগতিক এবং পারলৌকিক শাস্তিও ঘোষণা করেছে। পণ্যসামগ্রী জমা রেখে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে সমাজের দুর্ভোগ বৃদ্ধি ও অতি মুনাফা অর্জন করাকে দণ্ডনীয় কাজ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

মাওজুদ ও মজুদ শব্দ থেকে মজুদদারি শব্দটি এসেছে। মাওজুদ অর্থ হচ্ছে- সঞ্চিত, জমা, হাজির, উপস্থাপিত ইত্যাদি। আর মজুদদারি অর্থ হচ্ছে- দ্রব্যাদি অন্যায়ভাবে মজুদ বা জমা রাখা। যে ব্যবসায়ী অন্যায়ভাবে দ্রব্যাদি মজুদ করে রাখে তাকে মজুদদার বলা হয়। আরবি ভাষায় মজুদদারিকে ইহতিকার বলা হয়। ইহতিকার শব্দের অর্থ হচ্ছে- একচেটিয়াকরণ, একচ্ছত্র সুবিধাভোগ, মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পণ্য ধরে রাখা ইত্যাদি। লিসানুল আরব গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে- ইহতিকার শব্দটি (হাকরুন) শব্দমূল থেকে এসেছে। শব্দের অর্থ হচ্ছে, খাদ্যসামগ্রী আটকে রেখে পূঞ্জীভূত করা।

যে আটক রাখে তাকে (মুহতাকির) বলে। আরোয়িদ প্রণেতা বলেন, শব্দের অর্থ হচ্ছে- অন্যায়ভাবে হ্রাস করা, দুর্ব্যবহার করা, পণ্যসামগ্রী আটকে রাখা এবং উচ্চমূল্যে লাভবান হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শেষ অর্থটিই উদ্দেশ্য। আল-মুনজিদ অভিধানে বলা হয়েছে, ‘পণ্য মজুদ করে চড়া মূল্যের অপেক্ষায় আটকে রাখা। অতঃপর মূল্য বৃদ্ধি পেলে অধিক মুনাফায় তা বিক্রি করা’।’

ইসলামী আইনশাস্ত্রবিদদের মতে, ইসলামী পরিভাষায় মজুদদারি হচ্ছে- খাদ্যশস্য মজুদ করে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করা। অতঃপর মূল্য বৃদ্ধি পেলে তা বিক্রি করে প্রচুর পরিমাণে লাভবান হওয়া। আল-হিদায়া প্রণেতার ভাষায়- ইহতিকার বা মজুদদারি হচ্ছে- খাদ্যসামগ্রী ক্রয় করে মূল্য বৃদ্ধির আশায় গুদামজাত করা। ‘ইহতিকার হচ্ছে, খাদ্যসামগ্রী বা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে উচ্চমূল্যের জন্য ৪০ দিন পর্যন্ত পর্যন্ত আটক রাখা।’ ইমাম আবু ইউসুফের মতে- ‘যে সব জিনিস আটকে রাখলে সর্বসাধারণের কষ্ট হয়, তাকে ইহতিকার বা মজুদদারি বলে।’

ইমাম গাজ্জালী রা: বলেন, ‘মজুদদারি হলো- খাদ্যশস্য ক্রয় করে মূল্য বৃদ্ধি পেলে বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে মজুদ করে রাখা।’ ফাতওয়ায়ে রাহমানিয়ায় বর্ণিত হয়েছে- ‘মানুষ বা প্রাণীর প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী ও জিনিসপত্র সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে ক্রয় করে এমনভাবে জমা করে রাখা যে, বিশেষ প্রয়োজনের মুহূর্তেও (অর্থাৎ যখন ওই মালের অভাবে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর কষ্ট হয়) আরো বেশি মুনাফার আশায় বিক্রয় না করাকেই ইহতিকার বা মজুদদারি বলা হয়।’

যারা আল্লাহর সৃষ্ট জীবকে কষ্ট দিয়ে অধিক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে দ্রব্যসামগ্রী মজুদ করে রাখে, তাদের জন্য আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। দুনিয়াতেও তাদের ভয়াবহ পরিণতির কথা কুরআন ও হাদিসে ঘোষণা করা হয়েছে। কুরআনে আল্লাহ কারুনের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ কারুনকে তার ধনভাণ্ডার ও গৃহ-আসবাবসহ জমিনে দাবিয়ে দিয়ে শাস্তি দিলেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলিম সম্প্রদায়ের খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে রাখবে আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দিয়ে শাস্তি দেবেন।’

আল্লামা ইউসুফ কারযাভী বলেন, মজুদদারি দু’টি শর্তে হারাম। যথা- ১. এমন এক স্থানে ও এমন সময় পণ্য মজুদ করা হবে যার কারণে জনগণের তীব্র অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে; ২. মজুদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে অধিক মূল্য হরণ। যার ফলে মুনাফার পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে। আল-মুগনি ওয়াশ মারহুল কাবির আলা মাতানিল মুকনি ফি ফিকহিল ইমাম আহমাদ গ্রন্থকারের মতে, তিনটি শর্তে মজুদদারি হারাম।

 যথা- ১. পণ্য ক্রয়কৃত হতে হবে। যদি পণ্য আমদানিকৃত হয় বা নিজস্ব উৎপাদিত হয়, আর তা মজুদ করে রাখে তাহলে ইহতিকার হিসেবে গণ্য হবে না। ২. পণ্য একান্ত প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য হতে হবে। সুতরাং মসলা, হালুয়া, মধু, জায়তুন, গবাদি পশুর শুকনো খাদ্য ইত্যাদি মজুদ করে রাখলে তা হারাম হবে না। ৩. পণ্য ক্রয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগে নিপতিত হওয়া। এর আবার দু’টি পর্যায় রয়েছে- ক. ছোট শহর যেখানে পণ্য মজুদ করলে মানুষের কষ্ট হবে এবং মূল্য বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে- এমতাবস্থায় ইহতিকার হারাম। খ. পণ্যসামগ্রীর সঙ্কট বা অভাবের সময় যদি কোনো বণিকদল দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে শহরে প্রবেশ করে আর ধনী লোকেরা দ্রুত তাদের কাছ থেকে তা কিনে নেয়, ফলে মানুষের মাঝে পণ্যের সঙ্কট দেখা দেয়, তাহলে ইহতিকার হারাম হবে। আর যদি খাদ্যসামগ্রী বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ থাকে এবং কম মূল্যে ক্রয় করা যায়।

আর এতে মানুষের কষ্ট না হয় তাহলে ইহতিকার হারাম হবে না। আল-হিদায়া গ্রন্থকারের মতে, পণ্য মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তুর খাদ্য হতে হবে এবং মজুদদারির কারণে মানুষ ও জীবজন্তুর কষ্ট হওয়ার সম্ভবনা থাকতে হবে। আর যদি কষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে ইহতিকার করা নিষিদ্ধ নয়।

বাজার ও দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক গতিতে চলুক এটাই ইসলামের দাবি। রাসূলুল্লাহ সা: দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ থেকে বিরত থেকেছেন। তাঁর আমলে একবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে লোকেরা এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্য দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিন। তখন নবী সা: বললেন, ‘প্রকৃতপক্ষে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণকারী হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ। তিনিই মূল্য বৃদ্ধি করেন। তিনিই সস্তা করেন। রিজিকদাতা তিনিই। আমি তো আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে চাই এ অবস্থায় যে, কোনোরূপ জুলুম, রক্তপাত বা ধন-মালের অপহরণ ইত্যাদির দিক দিয়ে আমার কাছে দাবিদার কেউ থাকবে না।’

সাহাবাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ সা: দ্রব্যমূল্য নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করেননি। কেননা, দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের অধিকারী হচ্ছে ক্রেতা ও বিক্রেতা। দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করতে গেলে তাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ হবে, যা কোনো মতেই সমীচীন নয়। বরং তা আরো জুলুমের শামিল।

তবে ব্যবসায়ীরা যদি স্বেচ্ছাচারী হয়ে মাত্রাতিরিক্ত চড়া মূল্যে পণ্য বিক্রি করে ভোক্তাসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা ও দুর্ভোগ সৃষ্টি করে তাহলে জনগণকে মূল্য বৃদ্ধির শোষণ থেকে মুক্ত করতে এবং তাদের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণ করতে সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শক্রমে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দেবে এবং ব্যবসায়ীদের তা মানতে বাধ্য করবে।

আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী বলেন, ‘গণঅসন্তোষ সত্ত্বেও অন্যায়ভাবে যদি কোনো হালাল বস্তুর উচ্চ মূল্য চাপিয়ে দেয়া হয়, তবে তাও হবে হারাম। পক্ষান্তরে লোকদের মধ্যে সুবিচার ও ইনসাফ কার্যকর করার উদ্দেশ্যে যদি মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয় এবং যৌক্তিক দামে বিক্রয় করতে ব্যবসায়ীদেরকে বাধ্য করা হয় কিংবা প্রচলিত বিনিময় মূল্যের অধিক গ্রহণ থেকে তাদের বিরত রাখা হয় তাহলে তা শুধু জায়েজই নয়, ওয়াজিবও।’

ইসলাম মানব জাতির কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জীবনের সর্বক্ষেত্রে যুগোপযোগী বিধান দিয়েছে। ব্যবসায়-বাণিজ্যের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডেও কল্যাণকর নীতি-আদর্শ উপহার দিয়েছে। এ নীতির অন্যতম দিক হলো- মজুদদারি, মুনাফাখোরি, কালোবাজারি ও যেকোনো প্রতারণামূলক ব্যবসায়-বাণিজ্যের নিষিদ্ধকরণ। ইসলাম অতি মুনাফার লোভে প্রতারণা করে ও অপকৌশল অবলম্বন করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী আটক রাখাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।

আধুনিককালেও যেখানে পৃথিবীর নানা স্থানে মজুদদারির প্রভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনসাধারণ বিপর্যপ্ত, সেখানে ইসলাম বহুকাল আগেই এর আইনগত বিধান বর্ণনা করে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের অধিকার নিশ্চিত করেছে। ইসলাম নির্দেশিত পন্থায় যদি ব্যবসায়-বাণিজ্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা হয় তাহলে শুধু মজুদদারির অপতৎপরতাই নয়, ব্যবসায়-বাণিজ্যে কোনো ধরনের নৈরাজ্য থাকবে না।