নারীর রূপচর্চা ও ইসলামের নির্দেশনা

নারীর রূপচর্চা ও ইসলামের নির্দেশনা

প্রতীকী ছবি।

আল্লাহ তায়ালা সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। ইসলাম সৌন্দর্যচর্চার আনুমোদন দেয়। তবে এর নির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা আছে, যেন তা পাপে পরিণত না হয়। (মুসলিম: ৯১) ।

নারী মাত্রই সৌন্দর্যের প্রতি দুর্বল। নিজেকে কীভাবে সুন্দর করে উপস্থাপন করা যায় এ নিয়ে অনেকের মাঝে বেশ চঞ্চলতা অনুভব হয়। ইসলাম নারীকে বৈধ সাজসজ্জা করতে বাধা দেয় না। বরং বিবাহিত নারীকে তার স্বামীর নিকট সুসজ্জিত ও পরিপাটি থাকার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। একজন মুসলিম নারীর যাবতীয় সাজসজ্জা ও শোভা-সৌন্দর্য হবে স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য। তাই শুরুতেই ভাবতে হবে সাজসজ্জা আপনি কার জন্য কিংবা কাকে দেখানোর জন্য করছেন। কারণ পবিত্র কুরআনুল কারীমে নারীদের সৌন্দর্য বাহিরে প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে আপন স্বামীর সামনে সাজসজ্জা কেবল বৈধই নয়, বরং করণীয়ও বটে। হয়রত উমামা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলতেন, কোনো মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহরভীতির পর উত্তম যা কিছু লাভ করে তা হলো পূণ্যময়ী স্ত্রী, স্বামী তাকে কোনো নির্দেশ দিলে সে তা পালন করে। সে তার দিকে তাকালে (তার হাস্যোজ্জল চেহারা ও প্রফুল্লতা) তাকে আনন্দিত করে এবং সে তাকে শপথ করে কিছু বললে সে তা পূর্ণ করে। আর স্বামীর অনুপস্থিতিতে সে তার সম্ভ্রম ও সম্পদের হেফাজত করে।’ (ইবনে মাজাহ: ১৮৫৭)।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য হলো, আজকাল মুসলিম নারী অঙ্গনে কৃত্রিম রূপচর্চা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পার্লার ব্যবসার নামে এই মহামারী শহরের অলি-গলি পেরিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ধর্মীয় বিধিবিধানের প্রতি উদাসীন নারীরা পার্লার সংস্কৃতিকে হাল ফ্যাশনের প্রতীকরূপে জানে। অথচ এসব পার্লারগুলো রূপচর্চার আড়ালে শরীয়ত লংঘন করছে এবং অশ্লীলতার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। তাই এহেন পরিস্থিতিতে জানতে হবে নারীর জন্য কী ধরনের সাজসজ্জা বৈধ! এ ব্যাপারে ইসলামী শরীয়তের মূলনীতি হলোÑ

১. যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো সাজসজ্জা হারাম হওয়ার দলীল না পাওয়া যাবে, ততক্ষণ তা বৈধ। আর হারাম পাওয়ার দলীল পাওয়া গেলে অবৈধ। কারণ বস্তুর মূল হচ্ছে, বৈধতা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আপনি বলুন, আল্লাহ নিজের বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে? (সূরা আল-আরাফ: ৩২)।

২. কোনো নারী সাজসজ্জা করতে গিয়ে পুরুষের বেশ ধারণ করতে পারবে না। যেমন: ছোট পোষাক ও ছোট চুল, যার দ্বারা দূর থেকে পুরুষ মনে হয়। ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ সা. নারীর বেশ ধারণকারী পুরুষদের এবং পুরুষ বেশ ধারণকারী মহিলাদেরকে অভিশাপ করেছেন।’ (বুখারী: ৫৮৮৫)।

৩. সাজসজ্জা ও রূপচর্চায় কোনো অমুসলিম বা প্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত কারো অনুকরণ করা যাবে না। রাসূল সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে।’ (আবু দাউদ: ৪০৩১)।

৪. সাজসজ্জার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর বস্তু বা প্রসাধনী ব্যবহার করা যাবে না। কারণ এগুলোতে হাইড্রোকুইনোন নামে একটি পদার্থ থাকে, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ প্রসঙ্গে নবীজি সা. বলেন, ‘ক্ষতি ও ক্ষতিসাধনের কোনো অনুমতি (ইসলামে) নেই।’ (দারাকুতনি: ৩০৭৯)।

চেহারার সাজসজ্জা:
১. ভ্রু প্লাক করা। সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন উপায়ে ভ্রু চিকন করার যে প্রথা বর্তমানে প্রচলিত আছে, তা বৈধ নয়। বরং হারাম। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. হতে বর্ণিত, ‘আল্লাহ তায়ালা অভিশম্পাত করেছেন, সেসব নারীদের ওপর যারা দেহাঙ্গে উল্কি উৎকীর্ণ করে এবং যারা করায়, তেমনি যারা ভ্রু উঠিয়ে সরু (প্লাক) করে, যারা সৌন্দর্য বাড়াতে দাঁতের মাঝে ফাঁকা সৃষ্টি করে এবং যারা আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তন আনে।’ (বুখারী: ৪৮৮৬)।

২. চেহারায় উল্কি অংকন করা। উক্ত হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, শুধু চেহারা নয়; বরং দেহের যে কোনো অঙ্গে উল্কি অংকন করা হারাম।

৩. চোখে রঙিন পর্দা বা কন্ট্যাক্ট লেন্স। আজকাল কন্ট্যাক্ট লেন্স ফ্যাশনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে ওঠেছে। এটি চশমার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মেয়েদের অনেকেই কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করে যেন অমুসলিম নারীদের ন্যায় তাদের চোখ নীলাভ বা বিভিন্ন রঙের দেখায়। আবার অনেকে নিজের পোষাকের সঙ্গে মিলিয়ে এটি ব্যবহার করে। এটা নিছক ফ্যাশন। যা জায়েজ নেই।

৪. ফেক আইল্যাস বা কৃত্রিম পাপড়ি লাগানো। মুহূতেই চোখের আবেদন সহ¯্র গুণ বাড়িয়ে দেয় ফেক আইল্যাস। ইসলামী শরীয়তে তাও হারাম। ড. খালিদ আল-মুসলিহ বলেন, ‘আমি আশঙ্কা করি এটিও নিষিদ্ধ পরচুলার অন্তর্ভুক্ত, যার কর্তাকে আল্লাহ তায়ালা লানত করেছেন। রাসূল সা. বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা পরচুলা ব্যবহারকারিণী ও যে করায় উভয়কে লানত করেছেন। করণ এটা প্রতারণা। তাই মুসলিম বোনদের প্রতি আমার নিবেদন যে, তারা যেন এ ধরনের মেকআপ থেকে বেঁচে থাকেন একং বৈধ মেকআপে সন্তুষ্ট থাকেন।

৫. মেকআপ করা। যেমন: বর্তমানে ¯েœা, ক্রিম, পাউডারসহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী পাওয়া যায়। এগুলো ব্যবহার করা জায়েজ। কারণ ইসলাম নারীকে মেহেদী, কলপ ইত্যাদি ব্যবহারের অনুমতি দেন, আর আধুনিককালে এসব কিছুও এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। কেউ কেউ বলেন, এগুলো ত্বকের ক্ষতি না করার শর্তে বৈধ।

৬. দাঁত স্কেলিং করা বা আঁকাবাঁকা দাঁত সোজার উদ্দেশ্যে ব্রেস পরানো। এটি কেবল ফ্যাশন কিংবা এতে কোনো ক্ষতির আশঙ্কা হলে তা জায়েজ নেই। পক্ষান্তরে কারো দাঁত অস্বাভাবিক বাঁকা বা অতিরিক্ত থাকলে তা সোজা করা কিংবা অন্য কোনো চিকিৎসার জন্য হলে বৈধ। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, যারা অনর্থক দাঁতের মাঝে ফাঁকা তৈরি করে হাদীসে তাদের ব্যাপারে লানত এসেছে। (ফাতহুল বারী: ১০/৩৭২)।

৭. পোষাক সাজসজ্জার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ বস্তু। নারী ও পুরুষ যেহেতু পৃথম সত্তা। সৃষ্টিগতভাবে তাদের মাঝে বেশ পার্থক্য আছে। তাই সবকিছুতেই তা বজায় রাখা চাই। সুতরাং নারীদের জন্য পুরুষদের মতো কাটছাঁটের পোষাক পরিধান করা এবং তাদের সদৃশ্য অবলম্বন নিষিদ্ধ। (বুখারী: ৫৫৪৬)। পোষাকের উদ্দেশ্য হলো, আবৃত করা। যা লজ্জাস্থান, সতর ও নারীদের সৌন্দর্যের স্থানগুলো ঢেকে রাখার জন্যই পরিধান করা হয়। তাই কোনো নারীকে টাইটফিট জামা, টাইটফিট বোরকা বা পাতলা পোষাক পরে বাহিরে বের হওয়া জায়েজ নেই। (আল মুফাসসাল ফি আহকামিল মারআ: ৩/৩৩০)। তবে এগুলো কেবল স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য বাড়ির অভ্যন্তরে পরা যাবে। এক্ষেত্রেও এমন পোষাকে কোনো বেগানা নারী, পিতা-মাতা ও সন্তানদের সামনে যাওয়া উচিত নয়।

বর্তমান ফ্যাশনের যুগে নিউ মডেল বা আধুনিক জামা-কাপড় পরা তখনই বৈধ হবে যখন তা পর্দার কাজ দেবে এবং তাতে কোনো কাফেরের অনুকরণ না হবে। আর নারীদের সেলোয়ার টাখনুর নিচে থাকা উচিত। (ফাতহুল বারী: ১০/২৫৯)।

তবে এসব বস্তু ব্যবহারের সময় নি¤েœাক্ত বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে : ১. বিজাতি কিংবা প্রকাশ্য পাপাচারে লিপ্ত নারীদের অনুকরণ করার উদ্দেশে হলে এসবের ব্যবহার জায়েজ হবে না। ২. মেকআপে ক্ষতিকর বস্ত বা প্রসাধনী ব্যবহার করা যাবে না । কেননা, আমাদের দেহের মালিক আমরা নই। ৩. অতিরিক্ত রূপচর্চা করা যাবে না। কেননা, অতিরিক্ত রূপচর্চা হয়তো ত¦কের ক্ষতি করে কিংবা অপচয়ের সীমায় পড়ে। ৪. যে সমস্ত প্রসাধনী হালাল বস্ত দ্বারা তৈরী, সেগুলোর ব্যবহার জায়েজ । যেমন- সাধারণ মেকআপ, লিপস্টিক ইত্যাদি। তবে এগুলোর উপাদানে যদি হারাম কিছু থাকে, এমনটি নিশ্চিতভাবে জানা থাকলে সেগুলো ব্যবহার করা জায়েজ হবে না। ৫. যেসব সাজ সামগ্রীতে অ্যালকোহল ব্যবহার করা হয়, সেগুলো যদি আঙ্গুর বা কিসমিসের তৈরী না হয় এবং নেশার পরিমাণে না পৌঁছায়, তাহলে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতানুযায়ী তা ব্যবহার জায়েজ। আর যদি আঙ্গুর বা কিসমিসের তৈরী হয়- তাহলে সামান্য পরিমাণ ব্যবহারও জায়েজ নয়।

সাজসজ্জার আরো কিছু সামগ্রী:
১. নেইলপলিশ। যদি পবিত্র বস্তু দ্বারা প্রস্তুত হয়, তাহলে ব্যবহার করা জায়েজ। তবে নেইলপলিশ যেহেতু পানি প্রবেশের প্রতিবন্ধক, তাই তা নখে থাকাবস্থায় অজু ও ফরজ গোসল হবে না। নখ থেকে তুলে অজু ও ফরজ গোসল করতে হবে। তবে পিরিয়ড অবস্থায় নেইলপলিশ ব্যবহার করলে করতে পারবে। বারবার অজুর সুবিধার্থে পিরিয়ডমুক্ত পবিত্রাবস্থায় নেইলপলিশ ব্যবহার না করাই অধিকতর নিরাপদ। (আপকে মাসায়েল: ৭/১৩৭)।

২. সেন্ট, পারফিউম বা বডি স্প্রে ইত্যাদির ব্যবহার জায়েজ। তবে শর্ত হলো, আঙ্গুর, খেজুর অথবা কিসমিসের তৈরী না হওয়া এবং এগুলোতে কোনো ধরনের নাপাক বস্তুর মিশ্রিত না থাকা। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘নেশা সৃষ্টিকারী প্রতিটি বস্তুই হারাম।’ (বুখারী: ৪৩৪৩) তাছাড়াও হাদীস শরীফে এসেছে, ‘যে নারী সুগন্ধি ব্যবহার করল অতঃপর লোকদের পাশদিয়ে এ উদ্দেশ্যে অতিক্রম করল যেন তারা তার সুঘ্রাণ পায়, তাহলে সে ব্যভিচারী’ (নাসায়ী: ৫১২৬)। তাই বাড়ির বাইরে সুগন্ধি ব্যবহার মাকরূহ। তবে মুসলিম নারীরা গৃহের অভ্যন্তরে অবশ্যই সুগন্ধি ব্যবহার করবে। (তুহফাতুল আহওয়াজি: ৮/৭১)।

৩. পরচুলার ব্যবহার। নারীরা পরচুলা ব্যবহার করতে পারবে যদি তা সুতা, পশম, কাপড় বা এজাতীয় কিছু দ্বারা তৈরি করা হয় এবং চুলের সাদৃশ্য না হয়। আর যদি মানুষের চুল দ্বারা তৈরি করা হয় বা চুলের সাদৃশ্য হয়, তাহলে এমতাবস্থায় তা সর্বসম্মতক্রমে হারাম। (বুখারী: ৪৮৮৬, হিন্দিয়া: ১/৯৪)।

নারীর রূপ-লাবণ্য, শোভা-সৌন্দর্য ও কমনীয়তা নারীর গর্ব। তার এ রূপ-যৌবন দেওয়া হয়েছে কেবল তার স্বামীর জন্য। স্বামীকে সে রূপ উপহার না দিতে পারলে নারী জীবনের কোনো মূল্যই থাকে না। সুতরাং অঙ্গ যার জন্য নিবেদিত অঙ্গরাগও তার জন্যই নির্দিষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক। স্বামী ব্যতীত অন্য কারো জন্য অঙ্গসজ্জা করা ও তা প্রদর্শন করা জায়েজ নয়। কালের পরিক্রমায় নারীদের মেকআপ ও প্রসাধন সামগ্রীর বৈচিত্র বেড়েছে। তাই আধুনিক কালের এই সময়ে নিজেকে যত সংযত রাখা যাবে, আখেরাতের দিকে তত এগোবে।

একজন নারী খুব সহজেই তার চিন্তা, অভিরুচি, মননশীলতা, রুচিশীলতা ও নান্দনিকতা তার পারিবার থেকে ধীরে ধীরে জাতীয় জীবনে ছড়িয়ে দিতে পারে। আজকের নারীসমাজ যদি স্বর্ণযুগের মুসলিম মহিলাদের দিকে দৃষ্টিপাত করে , তবে দেখতে পাবে তারা সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতা নয় বরং তাকওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। ‘কে কার চেয়ে বেশি সুন্দরী’ এসব সাধারণ ঠুনকো বিষয়ে মাথা না খাটিয়ে, ইসলামের পথে কীভাবে আত্মনিয়োগ করা যায় সে কথা ভাবতেন। আল্লাহর নিকট রঙ, রূপ, আকৃতি, অর্থ-বিত্ত ইত্যাদির কোনো মূল্য নেই। তাঁর নিকট ওই ব্যক্তি সম্মানিত যিনি তাকওয়ায় সবার চেয়ে অগ্রগামী। (সূরা হুজরাত: ১৩) আল্লাহ সবাইকে তাঁর নির্দেশিত পথে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: নাজমুল হাসান সাকিব, শিক্ষার্থী, ইসলামী আইন ও গবেষণা বিভাগ, আল মারকাজুল ইসলামী (এএমআই) বাংলাদেশ।