‘বিভক্তি’ নিয়েই নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে পাকিস্তান

‘বিভক্তি’ নিয়েই নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে পাকিস্তান

‘বিভক্তি’ নিয়েই নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে পাকিস্তান

যখন পাকিস্তানের রাজনীতির বিষয় আসে, “কারোরই স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার নাই”, বিবিসিকে বলছিলেন লাহোরের শিক্ষার্থী আমনা।

পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করতে দেশটি ৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের দিকে এগুচ্ছে। কিন্তু ভোটাররা জানান, পাকিস্তানের মানুষ এতটাই বিভক্ত যে তারা নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলতে অস্বস্তি অনুভব করছেন।রাজনীতি এখন এতটাই মেরুকরণ হয়ে গেছে যে এ নিয়ে মতানৈক্যের ঘটনায় নিজের সন্তান আতা উর রেহমানকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে তার বাবার বিরুদ্ধে।

আতার ভাই আরিফ বিবিসিকে বলছিলেন, “আমাদের পুরো পরিবার শোকাহত”।আরিফ বলেন, তার ভাই কাতারের চাকরি করতেন। ছুটিতে এসে পেশোয়ারে বাবার সাথে থাকছিলেন।“আতা বাড়ির ছাদে পিটিআইয়ের পতাকা টাঙাতে চাইলে দুজনের মধ্যে তর্ক শুরু হয়। যদিও আমার বাবা কোনো রাজনৈতিক দল সমর্থন করেন না, তিনি এটি পছন্দও করেন না।”

পিটিআই বা পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল।২০২২ সালে বিরোধী দলগুলোর অনাস্থা ভোটে মি. খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এখন তিনি দুর্নীতি ও গোপন নথি ফাঁসের অপরাধে কারাভোগ করছেন, তার নির্বাচনে অংশগ্রহণের ওপরও দেয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা।

আরিফ জানান, উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডার পর তার বাবা আতাকে গুলি করে পালিয়ে যান। পরে পুলিশ আতার মৃত্যু নিশ্চিত করেছে।যদিও এটি একটি বিরল ঘটনা, তবে অনেক লোকজন বলেছে যে নির্বাচনের সময় তারা পরিবারের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে।ইমরান খানের অন্ধ সমর্থক নিদা জিশান বলেন, “আমার বোন এবং আমি বাবার সাথে তিন মাস কথা বলিনি।”

ইমরান খানেকে জেতানোর জন্য নিদা এবং তার বোন ২০১৮ সালের নির্বাচনে পিটিআইকে ভোট দিয়েছিলো। কিন্তু এটি তাদের পরিবারে বিভক্তি সৃষ্টি করে।“আমার বাবা খানের নির্বাচনি ইশতেহারের সাথে একমত নয় এবং তার মতে খান ভালো রাজনীতিবিদ নন।”অন্য যেসব তরুণের সাথে আমি কথা বলেছি, তাদের মতো নিজের মত প্রকাশে ভীত ছিল না নিদা।

“আমি আমার বাবার সাথে দ্বিমত করে বলতাম যে, আমি খানকে এবং তার ব্যক্তিত্বকে ভালোবাসি। আমি তার নির্বাচনি ইশতেহার পছন্দ করেছিলাম।”২০২৪ এর নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম হবে না বলে জানিয়ে নিদা বলেন, কেউ যদি তার সাথে দ্বিমত করে সে তাদের সাথে দেখা করা বন্ধ করে দেবে, নয়তো সে আলাপ ঝগড়া পর্যন্ত গড়াবে।

তার সঙ্গে একমত না হলেও ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা তার মতামতকে শ্রদ্ধা করে বলে জানান তিনি।“আমার বন্ধুর স্বামী অন্য দল থেকে এবারর নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। সে খুব ভালো করেই জানে আমি তাকে ভোট দেবো না, আর তাই সে আমার কাছে সমর্থন চায়নি।”

কেন এই নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ?

ভারতের সাথে বৈরিতা, ইরান এবং তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের সাথে সীমান্ত অস্থিরতা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অম্ল-মধুর সম্পর্ক এবং চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতা পাকিস্তানকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক খেলোয়াড় করে তুলেছে।আর তাই পরমাণু শক্তিধর এই দেশে যে-ই ক্ষমতায় আসুক না কেন তা গোটা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ইরানের সাথে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনায় এই নির্বাচন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ দেশটির জনগণ স্থিতিশীলতা চাইছে।সামরিক ও স্বৈরশাসনের এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে পাকিস্তানের, আর এই ভোটও অনুষ্ঠিত হচ্ছে সামরিক হস্তক্ষেপের অভিযোগের মধ্যেই।পিটিআইইয়ের প্রার্থীদের অনেকের কারাগারে থাকা, পালিয়ে বেড়ানো অথবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানোর মতো বিষয়গুলোর কারণে অনেকে বলছেন ইমরান খানের দলকে নির্বাচনে সমান সুযোগ দেয়া হয়নি।

দলটির কাছে থেকে তাদের প্রতীক ক্রিকেট ব্যাটও ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে যেটি লাখ লাখ নিরক্ষর ভোটারদের আকৃষ্ট করতে সহায়ক ছিল।পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) (পিএমএল-এন) থেকে তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ বিপরীত ভূমিকায় আবার ফিরে এসেছেন। দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে থাকায় গত নির্বাচনে তিনি নিষিদ্ধ ছিলেন।কিন্তু স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে তিনি আবার ফিরে এসেছেন এবং তার দণ্ড মওকুফ করা হয়েছে।

নির্বাচনের আরেকজন প্রার্থী পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলওয়াল ভুট্টো জারদারি। ৩৫ বছর বয়সী বিলওয়াল এই নির্বাচনে সর্বকনিষ্ঠ প্রতিদ্বন্দ্বী।তার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো, যাকে ২০০৭ সালে হত্যা করা হয়েছিলো। তার বাবা এবং নানাও সাবেক প্রেসিডেন্ট; তাই সমালোচকরা স্বজনপ্রীতির সুবিধাভোগী বলে প্রায়ই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন।

কেন পাকিস্তান এতো বিভক্তি?

দেশটি কেন এত বিভক্ত তা নিয়ে পাঞ্জাবের এক ব্যক্তির একটি থিওরি আছে। কীভাবে একজন রাজনীতিবিদ তার বিরোধীদেরকে টেনে-হিঁচড়ে রাস্তায় নামানোর কথা বলেছেন এই উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “পাকিস্তানের জনগণ তাদের নেতাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে মাত্র।”অপর আরেক ব্যক্তি ইমরান খানকেই দোষ দিচ্ছিলেন। “রাজনীতিতে খানের আগমনে এই অসহিষ্ণুতা ছড়িয়ে পড়ে। তিনি সবাইকে অভিযুক্ত করছেন, সবাইকে চোর বলেছেন”।

খান বিভাজনে ভূমিকা রেখেছেন এ ব্যাপারে একমত হলেও পিটিআই সমর্থক মুহাম্মদ হাফিজ বলেন, এটা খারাপ কিছু নয়।“আগে জনগণ তাদের রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে কথা বলার ব্যাপারে সচেতন ছিল না। খান ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে দুটি দল দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করছে। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে পরিবর্তন আনতে হবে।”

খান এভাবে পাকিস্তানে মতের বিভক্তি তৈরি করেছেন।লাহোরে একদল শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলার সময় আয়েশা নামের এক তরুণী বলেন, “ইমরান খান একজন অসাধারণ বক্তা। তিনি তার শব্দের শক্তি সম্পর্কে সচেতন; কিন্তু এই ক্ষমতা দিয়ে যুব-সমাজকে একত্রিত করার পরিবর্তে বিভাজন সৃষ্টি করেছেন তিনি”।

অপর এক শিক্ষার্থী তার মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, “ইমরান খান এই দেশের জন্য সবকিছু করেছেন এবং এরপর কী হয়েছে? তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে”।এই আলোচনা উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের দিকে ধাবিত করলে তাদের এই মনে করিয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল- “আমরা শুধু কথাই বলছি, ঝগড়া করার প্রয়োজন নেই।”

রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক আজকাল এভাবেই শেষ হচ্ছে পাকিস্তানে। কিন্তু একটি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা একমত- নির্বাচন দুর্নীতিমুক্ত হওয়া উচিত।আমনা প্রশ্ন করে, “এই দেশে কি আমরা কাউকে প্রকাশ্যে সমর্থন করতে পারছি?“ যদি তুমি কিছু বলো তাহলে পুলিশ এসে তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। যারা তাদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে তাদের দমিয়ে দেয়া হয়েছে”।রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী হুমায়রা একমত যে, “কোন প্রকার হস্তক্ষেপ ছাড়াই কেবল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিকশিত হতে পারে। এটাই পাকিস্তানের বিভাজন দূর করার একমাত্র উপায়”।

সূত্র  : বিবিসি