দেশপ্রেম সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

দেশপ্রেম সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

প্রতীকী ছবি।

ইসলামের দৃষ্টিতে দেশাত্মবোধ একটি প্রশংসনীয় গুণ। দেশাত্মবোধ একটি স্বভাবজাত প্রেরণা। জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা ও আকর্ষণকে গভীরতর পর্যায়ে নিয়ে গেলেই তা দেশাত্মবোধে পরিণত হয়।
দেশপ্রেম ও আত্মমর্যাদাবোধ স্বাধীন-সার্বভৌম যেকোনো দেশের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ। দেশের প্রতি যার অন্তরে ভালোবাসা বিদ্যমান, দেশের মঙ্গল, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা তার সহজাত বিষয়। দেশীয় সংস্কৃতি লালন, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সচেতন থাকা, দেশ ও গণমানুষের শত্রুদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা, প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ত্যাগের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা দেশপ্রেমের অনুপম দৃষ্টান্ত।
মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা প্রত্যেক সুনাগরিকের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে যেসব নবী-রাসূল আ: মানবজাতির হেদায়াতের জন্য দুনিয়ার বুকে আবির্ভূত হয়েছেন, প্রত্যেকে আপন দেশ, মাতৃভূমি ও জনগোষ্ঠীকে ভালোবেসেছেন। আমাদের প্রিয় নবীজি সা:-এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।
পবিত্র মক্কা শরীফ থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছিলেন, ‘ভূখণ্ড হিসেবে তুমি কতই না উত্তম, আমার কাছে তুমি কতই না প্রিয়। যদি আমার স্বজাতি আমাকে বের করে না দিতো তবে কিছুতেই আমি অন্যত্র বসবাস করতাম না।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৩৯২৬)
মক্কা নগরী তো শুধু আল্লাহর রাসূলের জন্মভূমিই ছিল না, এ তো ঐ পবিত্র ভূখণ্ড, যেখানে আল্লাহর ঘর প্রতিষ্ঠিত।
পরবর্তী সময়ে যখন তিনি মদিনা মুনাওয়ারাকে স্থায়ী আবাসভূমি হিসেবে গ্রহণ করেন, তখন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে মদিনার প্রতি তাঁর হৃদয়ের অনুরাগ প্রকাশ করতেন।
এক হাদিসে হজরত আনাস রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: যখন কোনো সফর থেকে ফিরে আসতেন, দূর থেকে মদিনার জনপদ নজরে আসতেই তিনি তাঁর উটনীর গতি বাড়িয়ে দিতেন, অথবা কোনো চতুষ্পদ জন্তুর উপর থাকলে তাকে নাড়াতে থাকতেন। বস্তুত মদিনার প্রতি ভালোবাসার দরুনই তিনি এমনটি করতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস ১৮০২)
আরেক হাদিসে হজরত আনাস রা: বলেন, ‘আমি খেদমতের নিয়তে রাসূলের সাথে খায়বার অভিযানে গেলাম। অতঃপর যখন অভিযান শেষে নবীজি সা: ফিরে এলেন, উহুদ পাহাড় তাঁর দৃষ্টিগোচর হলো তিনি বললেন, এই পাহাড় আমাদেরকে ভালোবাসে, আমরাও একে ভালোবাসি। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৮৮৯)

মোটকথা, স্বদেশের প্রতি মানবমনের এই স্বভাবজাত অনুরাগকে ইসলাম সমর্থন করে। কিন্তু এই দেশপ্রেম যদি সীমা অতিক্রম করে আত্ম-অহমিকা কিংবা আত্মকেন্দ্রিকতার জন্ম দেয়, অথবা যদি মানুষকে অন্ধত্ব ও উগ্রতার দিকে নিয়ে যায় এবং আল্লাহর সৃষ্টি অন্য কোনো দেশ বা ভূখণ্ডের বিরুদ্ধে অন্যায় বিদ্বেষের জন্ম দেয়, তাহলে ইসলাম কখনোই তা সমর্থন করে না।
নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসার বিষয়টি যথাস্থানে ঠিকই আছে; কিন্তু তার সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে, ভৌগোলিক পরিচয়কে ইসলাম সম্মান-মর্যাদার মানদণ্ড গণ্য করেনি। ইসলামের কাছে মর্যাদার মানদণ্ড হচ্ছে তাকওয়া ও আল্লাভীতি। এই তাকওয়ার গুণে যে ভূষিত হবে সেই সম্মান-মর্যাদার অধিক উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে। চাই সে কোনো অখ্যাত দেশের বাসিন্দাই হোক না কেন।
আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। আর তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচে মর্যাদাবান সে যে আল্লাহকে সর্বাধিক ভয় করে।’ (সূরা : হুজুরাত, আয়াত-১২)
রাসূলে কারিম সা: বিদায় হজ্বের ভাষণে বলেন, ‘হে লোকেরা! জেনে রেখো তোমাদের প্রতিপালক একজন, তোমাদের পিতা একজন। জেনে রেখো, অনারবের ওপর আরবের, আরবের ওপর অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সাদার ওপর কালোর, কালোর ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তবে তাকওয়ার ভিত্তিতে একজন আরেকজনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, ৫/৪১১; বাইহাকির সূত্রে দুররে মানসুর ৬/১২২)
রাসূলুল্লাহ সা: আরো ইরশাদ করেন, ‘আমার নিকটবর্তী লোক তো তারাই যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে, তারা যেমনই হোক, যেখানেই থাকুক।’ (মুসনাদে আহমাদ ৫/২৩৫)

হযরত আবুদ দারদা রা:-এর এক চিঠির উত্তরে সালমান রা: লিখেছিলেন, ‘কোনো ভূখণ্ড কাউকে পবিত্র করে না। মানুষকে পবিত্র করে তার আমল।’ (মুয়াত্তা মালিক, পৃষ্ঠা : ৩২২)
দেশপ্রেম মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। ইসলাম সেটিকে গুরুত্ব দিয়েছে; কিন্তু ন্যায় ও ভারসাম্যের ধর্ম ইসলামে অন্য সব বিষয়ের মতো এ বিষয়েও নীতি ও বিধান দান করেছে, যা মুমিনকে সব সীমালঙ্ঘন ও প্রান্তিকতা থেকে রক্ষা করে।
ভূখণ্ড তো মানবের সেবক, সৃষ্টিকর্তা নয়, ইলাহ ও উপাস্যও নয়। সৃষ্টিকর্তা তো আল্লাহ, ইলাহও একমাত্র তিনিই। বন্দেগি ও উপাসনার একমাত্র অধিকারী তিনি। চূড়ান্ত ভক্তি-ভালোবাসা ইতাআত ও আনুগত্যও একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য। অন্য সব ভক্তি ও আনুগত্য তাঁরই বিধানের অধীন।
মানবের ভূখণ্ড তো মানবের চেয়ে বড় নয়, ভ্রাতৃত্বের সম্প্রীতি ও আদর্শের চেয়েও বড় নয়। তাহলে ভূখণ্ডের কথা বলে কিভাবে মানুষ শিরক ও পৌত্তলিকতায় লিপ্ত হতে পারে? আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হতে পারে?
দেশের সীমানাকে কেন্দ্র করে ভাই তার ভাইকে ভুলে যাবে, একে অপরের প্রতি জুলুম করবে ইসলাম কখনোই তা সমর্থন করে না। আফসোস, যেদিন থেকে মুসলিম উম্মাহ নিজের ভৌগোলিক পরিচয়কে আসল পরিচয় জ্ঞান করতে শুরু করেছে সেদিন থেকে তাদের দুর্ভোগও শুরু হয়েছে। আজ আমরা ভৌগোলিক পরিচয়ে এমনি বুঁদ হয়ে আছি, পাশের রাজ্যের মুসলমানরা নিপীড়নের শিকার হলেও আমরা ‘সেদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ বলে ‘দায়মুক্ত’ থাকার মিথ্যা চেষ্টা করছি। অথচ হাদিস শরীফে এসেছে, ‘সব মুসলিম এক শরীরের ন্যায়। এর কোনো একটি অঙ্গ আক্রান্ত হলে অন্য সব অঙ্গ তার ব্যথায় ছটফট করবে।’


সুতরাং ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা থাকবে। সাথে অপর মুসলিম দেশের প্রতিও হিতাকাক্সক্ষা থাকতে হবে। নিজ দেশের মুসলিম ভাইদের আপন মনে করতে হবে। অমুসলিম নাগরিকেরও হক রক্ষা করতে হবে। অপর দেশের মুসলিম ভাইদেরও পর মনে করা যাবে না। ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের বোধ দেশের ভেতরে যেমন, দেশের বাইরেও তেমনি সব মুসলমানের প্রতি সম্প্রসারিত থাকবে।
দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা মানুষকে জাতীয় ঐক্য ও সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত করে পারস্পরিক সদাচরণ করতে শেখায়। তাই দেশের প্রকৃত উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধনে অবশ্যই স্বদেশপ্রেমের চেতনা জাগ্রত করতে হবে। দেশের প্রতি অনুগত থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে দেশমাতৃকাকে প্রাণাধিক ভালোবাসা সবার ঈমানি দায়িত্ব ও পবিত্র কর্তব্য।
লেখক : ইসলামী কলামিস্ট, মজলিশপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া