সম্পদের অপচয় কোনভাবেই কাম্য নয়

সম্পদের অপচয় কোনভাবেই কাম্য নয়

ছবিঃ সংগৃহীত।

‘যে জন দিবসে মনের হরষে/জ্বালায় মোমের বাতি, আশু গৃহে তার দেখিবে না আর/নিশীথে প্রদীপ-ভাতি।’ ধনসম্পদ অপচয়ের এ এক সাধারণ বাস্তবতা। কাড়ি কাড়ি সম্পদের মালিক যখন নীতি-নৈতিকতা ভুলে গিয়ে নিজের সম্পদ দুই হাতে অযথা নষ্ট করে, অপব্যয় করে বেড়ায়, তার সম্পদের গরিমা শেষ হতে তখন সময় লাগে না। অপ্রয়োজনে দিনের বেলা কেউ যদি মোমবাতি জ্বালিয়ে শেষ করে দেয় তাহলে রাতের অন্ধকারে জ্বালানোর মতো সে কিছুই পাবে না-এটাই স্বাভাবিক।

কোরআনে কারীমে অপচয়কারীকে বলা হয়েছে শয়তানের ভাই। ‘আত্মীয়কে তার প্রাপ্য দিয়ে দাও এবং মিসকিন ও মুসাফিরকেও; তবে কিছুতেই অপব্যয় করো না। সন্দেহ নেই, যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই, আর শয়তান তার প্রভুর প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ!’ (সূরা বনী ইসরাঈল : ২৬-২৭)।

এই তো অপচয়ের পরিণাম! আসলে ধনসম্পদ তো আল্লাহ তাআলার দেয়া এক বিশেষ নিআমত। তিনি সবাইকে সমানভাবে এ নিআমত দান করেন না। কাউকে বেশি দেন, কাউকে কম দেন। এ ব্যবস্থাপনাও আল্লাহর : এরা কি তোমার প্রভুর করুণা বণ্টন করে? আমিই তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বণ্টন করি, পার্থিব জীবনে এবং একজনকে অপরের ওপর মর্যাদায় উন্নীত করি, যেন একে অপরের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে। (সূরা যুখরুফ : ৩২)।

দুনিয়ার জীবনে চলতে গেলে এ সম্পদের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। এটা আল্লাহর আরেক ব্যবস্থাপনা। তিনিই একে আমাদের এ জীবনের বাহ্যিক অবলম্বন বানিয়েছেন। এর সঠিক ও যথার্থ ব্যবহার যদি করা না হয় তাহলে একদিকে যেমন তাঁর দেয়া নিআমতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা হবে, আবার আমাদের পার্থিব জীবনের অবলম্বনও নষ্ট হবে। পবিত্র কোরআনের বাণী : তোমরা যদি (আমার নিআমতের) কৃতজ্ঞতা আদায় করো তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরো বাড়িয়ে দেব, আর যদি অকৃতজ্ঞ হও তাহলে (জেনে রেখো) আমার শাস্তি অবশ্যই অত্যন্ত কঠিন! (সূরা ইবরাহীম : ৭)।

কৃতজ্ঞতা আদায়ের জন্যে এ বিশ্বাস ধারণ করা যেমন জরুরি-আমার এ সম্পদ আমার আল্লাহ আমাকে দয়া করে দান করেছেন, তেমনি এর ব্যয়ক্ষেত্রও হতে হবে আল্লাহ তাআলার বিধানমাফিক। অপ্রয়োজনে যেমন এ সম্পদ উড়ানো যাবে না, তেমনি অবৈধ প্রয়োজনেও তা ব্যয় করা যাবে না। নিআমতের কৃতজ্ঞতা আদায় করতে হলে এ উভয় দিক অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। অযথা ও অবৈধ খরচ থেকে বেঁচে থাকতে হবে।

কোরআনে কারীমের আরেক নির্দেশনা-কারো হাতে যদি কোনো এতিম শিশুর সম্পদ থাকে, তাহলে সে যেন তা যথাযথ সংরক্ষণ করে এবং সে প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়ার আগে যেন তার সম্পদ তার হাতে তুলে না দেয়। এতে যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে- সে বয়স ও অভিজ্ঞতার অভাবে তার এ সম্পদ অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ব্যয় করে নষ্ট করে ফেলবে, তার সম্পদের সে অপব্যবহার করবে।

ইরশাদ হয়েছে : তোমরা নির্বোধদের হাতে তোমাদের সম্পদ অর্পণ করো না, যা আল্লাহ তোমাদের জন্যে টিকে থাকার মাধ্যম বানিয়েছেন; তা থেকে তাদের জীবিকা ও পোশাকের ব্যবস্থা করো এবং তাদের সঙ্গে সুন্দর কথা বলো। আর তোমরা এতিমদের পরীক্ষা করো, অবশেষে তারা যখন বিয়ের বয়সে পৌঁছে, তখন যদি তাদের মাঝে ভালো-মন্দ বিচারের জ্ঞান উপলব্ধি কর তাহলে তাদের সম্পদ তাদের হাতে অর্পণ করো। (সূরা নিসা : ৫-৬)।
এতিম শিশুরা না বুঝে কিংবা দুষ্ট কারও প্ররোচনায় পড়ে যাতে তাদের সম্পদ হারিয়ে না ফেলে সেজন্যে কত দৃঢ় নির্দেশনা! বুঝ-বুদ্ধির অভাবে অযথা ও অপ্রয়োজনীয় খরচ তারা করতেই পারে। পরিণতিতে একসময় প্রয়োজনীয় খরচ করার মতো টাকা নাও থাকতে পারে। অপচয়ের এ দুয়ার তাই পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে এভাবে-তাদের ভালো-মন্দ বিচারের জ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত তাদের হাতে তাদের সম্পদ দেয়াই হবে না। এর পাশাপাশি, তারা যেন নিজেদের সম্পদের জন্যে অস্থির হয়ে না পড়ে সেজন্যে সান্ত্বনার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে এ বলে-তাদের তোমরা সুন্দর করে বুঝিয়ে বলো-এ সম্পদ তোমাদের, তোমরা বড় হলে তা অবশ্যই তোমাদেরকে দিয়ে দেয়া হবে।

উক্ত আয়াতে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। এতিমদের যে সম্পদ অভিভাবকদের হাতে থাকে, তা এখানে উল্লেখিত হয়েছে অভিভাবকদের সম্পদ হিসেবে-তোমরা নির্বোধদের হাতে ‘তোমাদের সম্পদ’ অর্পণ করো না। এ থেকে এ কথারও ইঙ্গিত মেলে-এ সম্পদ এখন যদিও এতিমদের মালিকানাধীন, কিন্তু এটা আসলে পুরো মানবজাতির জন্যেই আল্লাহর পক্ষ থেকে নিআমত।

এ সম্পদকে জগতের সকলের জন্যেই আল্লাহ টিকে থাকার অবলম্বন বানিয়েছেন। একজনের হাতে থাকলেও এর উপকার ভোগ করে সকলে মিলে। তা আজ একজনের হাতে তো আগামীকাল আরেকজনের হাতে। অবুঝ কোনো শিশু যদি তার মূল্যবান একটি জিনিস নদীতে ফেলে দেয় তাহলে এতে কেবল তার একার সম্পদই হারাল এমন নয়, বরং এ ক্ষতি সকল মানুষের। এর সংরক্ষণের দায়িত্বও তাই সকলের।